আবু আফজাল মোহা. সালেহ
জোড়াসাঁকো হয়ে নজরুলের চুরুলিয়া
বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপালÑ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দুজনেরই জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। একজন জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে অন্যজন দারিদ্র্যের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে এবং নজরুল বর্ধমান জেলার আসানসোলের প্রত্যন্ত অঞ্চল চুরুলিয়ায়। সৌভাগ্যক্রমে মে মাসেই দুজনের জন্মদিন পালন হয়।
অনেকেই জোড়াসাঁকোয় যান। কিন্তু চুরুলিয়ায় যাওয়া লোকের সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম! বর্ধমান পার হয়ে রানিগঞ্জের মধ্যে দিয়ে আসানসোল হয়ে চুরুলিয়ায় যাওয়া কম রোমাঞ্চকর নয়। সারি সারি কয়লা-পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ট্রেন ভ্রমণ কম মজার না! উঁচু উঁচু কয়লার পাহাড় বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় বলে শোনা যায় না। আবার বাসেও কলকাতা থেকে বর্ধমান হয়ে বাসযোগে আসানসোল যাওয়া যায়। আসানসোল রেল স্টেশন অত্যন্ত মনোরম। আরো রোমাঞ্চ লাগবে এই ভেবেÑ হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিল্লি-মুম্বাই-রাজস্থানগামী ট্রেন এই আসানসোল হয়েই যায়। এটিকে প্রবেশদ্বার বলা হয়। আর ওড়িশা-কেরালাগামীদের প্রবেশদ্বার হচ্ছে খড়গপুর। দুটি স্টেশনই নান্দনিক। ভারতের সবচেয়ে লম্বা প্ল্যাটফরম হচ্ছে খড়গপুর।
কলকাতা-হাওড়া থেকে উত্তরপ্রদেশ-দিল্লিগামী যেকোনো ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা গোহাটি-শিলিগুঁড়িগামী ট্রেনে বর্ধমানে নেমে লোকাল ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে আগে প্রোগ্রাম থাকলে শান্তিনিকেতন থেকে বাসে রানিগঞ্জ হয়ে আসানসোল যাওয়া যাবে। মজা বা শিহরণ জাগবে আসানসোল থেকে চুরুলিয়া যাওয়ার পথে। বাসগুলো অজয়ঘাট পর্যন্ত যায়। কষ্ট ভুলে যাবেন! চুরুলিয়া গ্রামে ঢুকতেই কবির ম্যুরাল দেখা যাবে। কবিতীর্থে যাওয়ার গলিপথে প্রথমেই হতাশ হতে হবে। ভাঙা রাস্তা, চিকন গলিপথ। মাটির ঘর। ছোটছোট ছেলে-মেয়েরা রাস্তায়ই খেলা করে। যানবাহনের কোনো ব্যস্ততা নেই। কবিতীর্থে পৌঁছে যাবেন অজান্তেই। পৌঁছে গেলেন ‘কবিতীর্থে’! প্রশ্ন জাগবে আর উত্তর পাবেন একইসঙ্গে! কবি কোথায় থাকতেন, কোথায় পড়তেন এবং স্কুলের আঙিনা! মসজিদের সামনেই পুকুর যেন কালের সাক্ষী! এখানে কবি সাঁতার শিখেছেন, গোসল করেছেন।
অজয় নদী দিয়ে ঘেরা নিভৃত প্রত্যন্ত গ্রাম চুরুলিয়া শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। তবে ‘কবিতীর্থ’ অবহেলায় পড়ে আছে। কয়েক বছর সরকার একটু নজর দিলেও তা অপ্রতুল! কবিতীর্থ বা নজরুলের বাড়ি এখন ‘নজরুল একাডেমি’। কবির জীবনের বাঁক নেওয়া বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাসসম্বলিত বই, ম্যাগাজিন ও পেপার কাটিং এ লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। কবির জন্মদিন উপলক্ষে কবিতীর্থে সাত দিনব্যাপী মেলার আয়োজন হয়। নজরুলের ছেলে সব্যসাচী কবির মৃত্যুর পর কবরের মাটি (বাংলাদেশে কবির কবর থেকে) নিয়ে কবির প্রতীকী কবরস্থান ও পাশে কবিপতœী প্রমীলা দেবীর কবর দারুণ অনুভূতি দেবে! ১৯৭৮ সাল থেকে জাঁকজমক করে অনুষ্ঠান পালন করে থাকে কবির ছোট ভাইয়ের পরিবার। তবে সরকারি অনুদান খুব কমই থাকে। কোনো কোনো বছর থাকে না!
নজরুলের বাড়িটির নিচতলায় নজরুল সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম। পাঁচ রুপি অনুদান ফি দিয়ে নজরুল ও তার সন্তানদের ব্যবহৃত পোশাক, সংগীত যন্ত্র, পুরাতন ম্যাগাজিন, পেপার কাটিং, কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, প্রমীলা দেবীর ব্যবহৃত খাট ও বিভিন্ন ছবি সংরক্ষিত রয়েছে; যা পর্যটকদের বাড়তি কৌতূহল মেটাবে।
নজরুল একাডেমিতে গবেষণা করার জন্য লাইব্রেরিতে কবির বিভিন্ন বই, তার সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন রয়েছে। পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটিও রয়েছে। কবির মক্তব এখন ‘নজরুল বিদ্যাপীঠ’। যেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয়। আরো আছে নজরুল কলেজ। একেবারেই ছোটগ্রাম চুরুলিয়া।
জাতীয় কবির বাস্তুভিটায় যাবেন, ভেবে দেখুন! উঁচুনিচু রাস্তা আর কালো পাহাড় পেরিয়ে চুরুলিয়া ‘কবিতীর্থ’। দিগন্তঘেঁষা কালো পাহাড়ের পাদদেশে ঐতিহাসিক চুরুলিয়া আর পাহাড়ের নিচেই কয়লাখনি। কয়লা-পাথর উত্তোলন করেই কালক্রমে এই কৃত্রিম পাহাড়শ্রেণি তৈরি হয়েছে। কলকাতা থেকে আসানসোল রেলপথে ২৩০ কিলোমিটার। হাওড়া-শিয়ালদহ থেকে বর্ধমান-রানিগঞ্জ হয়ে কালো পাহাড়ের এ পথ। এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা অঞ্চল রানিগঞ্জ বিট দিয়ে জিগজাগ পথে রোমাঞ্চ জাগবে মনে! আসানসোল স্টেশন পৌঁছালেই অটোতে যেতে হবে আসানসোল আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল। এখান থেকেই অজয় নদীর ঘাট পর্যন্ত লোকাল বাস পাবেন। ঘাটে যাওয়ার আগেই চুরুলিয়া বাজারে নেমে পড়তে হবে। আসানসোল থেকে ১৩ কিলোমিটার চুরুলিয়ার পথ অনায়াসেই পর্যটকের মনে দোলা দেবে।
এখানে থাকা-খাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। অনলাইনে বুকিং দিয়ে চুরুলিয়া নজরুল যুব ভবনে থাকা যেতে পারে। কবির জন্মদিন উপলক্ষে মেলায় আগত অতিথির একটি অংশ এখানে থাকেন। তবে আসানসোলে ইচ্ছেমতো দাম, মানে থাকতে পারবেন।
"