জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট
বোমা মেশিনে ঝুঁকিপূর্ণ দহগ্রামের গুচ্ছগ্রাম
বালু উত্তোলনের ফলে ভেঙে যাচ্ছে গুচ্ছগ্রাম
পূর্বে গুচ্ছগ্রামের অধিকাংশ ঘর ফাঁকা থাকলে নতুন করে আশ্রয়ণ প্রকল্প শুরু হয়েছে লালমনিরহাটের বহুল আলোচিত দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা গুচ্ছগ্রামে। ভূমিহীনদের জন্য নতুন আশ্রয়ণ তৈরিতে কাবিখা (কাজের বিনিময় খাদ্য)র মাধ্যমে বাইরে থেকে মাটি এনে জমি ভরাটের কথা। কিন্তু এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বালু বা পাথর উত্তোলনে প্রয়োগ নিষিদ্ধ বোমা মেশিন। এতে ভেঙ্গে যাচ্ছে গুচ্ছগ্রামের মাঠ ও ঘরবাড়ি। এদিকে কৃষি জমি রক্ষায় কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিত হাইকোর্ট ভূমি জরিপ তলব করলেও থামছে না প্রকল্প কাজ।
২০১৩ সালে দীর্ঘ দিনের অবরুদ্ধ লালমনিরহাট পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা তিন বিঘা করিডোর গেটটি খুলে দেওয়া হয়। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির মাধ্যমে অবমুক্ত বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের উন্নয়নে নানা মুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা তিস্তার চরাঞ্চলের ভূমিহীনদের ৮০টি পরিবারের বসবাসের জন্য একটি গুচ্ছগ্রামটি তৈরি করা হয়। এতে আশ্রয় নিয়েছে মাত্র ১৫-২০টি পরিবার। ৫০টি পরিবারের ঘরবাড়ি ফাঁকা রেখেই পাশের কৃষি জমিতে আরো একটি আশ্রয়ণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। তবে ওই কৃষি জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ না করতে জেলা জজ আদালত ও হাইকোর্টে মামলা করেছেন কৃষকরা। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে কৃষিজ জমি উদ্ধারের জন্য ভূমি সচিবের মাধ্যমে দহগ্রামের ভূমি রেকর্ডপত্র তলব করেছে হাইকোর্ট।
কৃষকরা জানান, ১৯৯২ সালে দিনে এক ঘন্টার জন্য দহগ্রাম করিডোর গেট মুক্ত করা হতো। ১৯৯৪ সালে সেখানে মাঠ জরিপের কাজ শুরু হয়। সে সময় বন্যার কারণে দহগ্রামের বড়বাড়ি, সৈয়দপাড়া, শালতলি প্রভৃতি গ্রামের প্রায় ১৪৫০ একর জমি মাঠ জরিপ না করেই জরিপ কাজের সমাপ্ত করা হয়। যা পরবর্তিতে সরকারী খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ওই এলাকার কৃষকরা বিষয়টি জানতে পেয়ে লালমনিরহাট জজ আদালতে দুইটি মামলা ও সাম্প্রতি হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে মামলা বিচারাধিন থাকলেও সরকারিভাবে ওই আশ্রয়ন প্রকল্পের এক একর মাঠ ভরাট করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অধিনে ৭০ মেট্রিকটন গম বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির চেয়ারম্যান হিসেবে দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন সদ্য নির্মিত গুচ্ছগ্রামের পাশে দুইটি বোমা মেশিনে বালু পাথর তুলে আশ্রয়নের মাঠ ভরাট কাজ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে বোমা মেশিনের তা-বে গুচ্ছগ্রামের মাঠ ও ঘর বাড়ি ভেঙ্গে যেতে বসেছে। ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত স্বপ্নের গুচ্ছগ্রাম।
বড়বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ফজলুল হক জানান, কৃষি জমিতে আশ্রয়ণ না করতে এবং তাদের জমি ফেরত পেতে তারা হাইকোর্টের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। হাইকোর্ট কাজ বন্ধের নির্দেশ দিলেও কাজ বন্ধ করেনি সরকার পক্ষ। তিনি প্রশ্ন তুলেন, এক গুচ্ছগ্রামেই থাকারই পরিবার নেই, সেখানে আরো একটি আশ্রয়ণের প্রয়োজন কি? তবে ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন অনেকটা গায়ের জোড়েই গুচ্ছগ্রামের মাটি ভরাটের কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
বোমা মেশিন মালিক মোজাহরুল ইসলাম জানান, আমরা বোমা মেশিন ভাড়া দেই। দহগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান কামাল ভাই আমাদেরকে গুচ্ছগ্রামের পাশ থেকেই বালু উত্তোলন করতে বলেছে। তাই আমরা এখান থেকেই বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছি। তাতে গুচ্ছগ্রামের পরিবারগুলোর লাভ বা ক্ষতি, কি হলো তা আমার জানার দরকার নেই। তবে বোমা মেশিন দিয়ে বালু বা পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধের পরও কেন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দেন নি তারা।
গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, ‘গরিবের কথা কায় শুনে বাহে। গরিব মানুষ মরুক বা পানিতে ভাসি গেলেও কারও কিছু যায় আসে না। চেয়ারম্যান নিজেই গুচ্ছগ্রামের ঘরের পিছনে বোমা মেশিন বসাইছেন। এখন কাকে বিচার দিমো বাহে?’
দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল হোসেন জানান, উপজেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তে ওই জমিতে বালু ভরাট করা হচ্ছে। বোমা মেশিনে কেন? এমন প্রশ্নে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। যদিও সেখানে মাটি এনে ভরাট করার কথা, তার পরেও গুচ্ছগ্রামের পাশেই বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
পাটগ্রাম উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা উত্তম নন্দি কুমার জানান, শ্রমিক দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাঠ ভরাটে বরাদ্ধের অর্ধেক বিল (৩৫ টন গম) ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। তবে বোমা মেশিনে বালু উত্তোলন করা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান তিনি।
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুর কুতুবুল আলম জানান, হাইকোর্টের একটি পত্র কৃষকরা হাতে হাতে দিয়েছেন। কিন্তু কোন অফিস কপি তিনি পাননি। অফিস কপি এলে আদালতের নির্দেশনা মেনে কাজ করা হবে। বোমা মেশিনে বালু উত্তোলন করে থাকলে খোঁজ নিয়ে প্রকল্প চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
"