প্রতীক ইজাজ

  ২০ আগস্ট, ২০১৭

দলগুলোকে নির্বাচনে আনায় মধ্যস্থতা করবে না ইসি

সরকারই সর্বশেষ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখনো সংলাপ বাকি; কিন্তু ইতোমধ্যেই অনুষ্ঠিত তিন দফা সংলাপ নিয়ে বেশ সমালোচনা ও আলোচনার মুখে পড়েছে ইসি। সংলাপে সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চেয়েছেন। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় এনে নির্বাচনে অংশ নিতে ইসিকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও মত দিয়েছেন তারা। তারা এমনও বলেছেন, ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে আস্থায় আনায় হবে ইসির মূল চ্যালেঞ্জ।

অথচ সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতার’ ভূমিকা নিতে সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সুপারিশ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। এ ছাড়াও নির্বাচনের সময় কী ধরনের সরকার থাকবে, সে নিয়েও ভাববে না কমিশন বলে জানিয়েছেন তিনি। সিইসি বলেছেন, সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করে দেবে, সেভাবেই ভোট সম্পন্ন করবে ইসি। এমনকি নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দেখা দেওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে ‘সমঝোতার’ চেষ্টাকে ‘অযথা সময় নষ্ট’ বলেও মন্তব্য করেছেন সিইসি। তিনি বলেছেন, অনেক আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক মেডিয়েটর এসে আমাদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সমাঝোতায় আসতে পারেনি। সেখানে আমি কেন সে রিস্ক নেব? এটা আমার কাজ না। এর আগে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ শেষে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা থেকে উঠে আসা পরামর্শের ভিত্তিতে প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা।

এমনকি আগামী ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ নিয়েও আগাম মন্তব্য করেছেন সিইসি। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলের সংলাপে শুধুই আলোচনা হবে, কারো নির্বাচনে আসা-না আসার বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে না। সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতার’ ভূমিকা নিতে চাই না।

সিইসির এমন সিদ্ধান্ত ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ফলে সর্বশেষ অংশ্রগহণমূলক নির্বাচনের মূল দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায় বলে মত দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও সংবিধান অনুযায়ী সরকারের বেধে দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী নির্বাচন করবে ইসি। সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার, সব দলকে আস্থায় এনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি কিংবা নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা-না করা-এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এখতিয়ার ইসির নেই। সুতরাং এসব সংকট সমাধান করে সরকারকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, সবকিছুই যে আইনে থাকতে হবে, এমন নয়। আইনের বাইরেও ইসি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে পারে। বিশেষ করে ইসি যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে আসার বিষয়ে আপত্তি থাকার কথা না। সে ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার বিষয়টিও আসবে না। সে ব্যাপারে ইসিকে দায়িত্ব নিতেই হবে।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে কী ভাবছে সরকার বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কোন বিষয়ে কতটুকু দায়িত্ব সংস্থাটি পালন করতে পারবে, কোন বিষয়ে তাদের এখতিয়ার কতটুকু, সেসব আইনে উল্লেখ আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতা করার সাংবিধানিক ক্ষমতা কমিশনের নেই। এ বিষয়ে কমিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপের সময় যথার্থই বলেছে। কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারে। তিনি আরো বলেন, সব রাজনৈতিক দল যেন আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়, এ বিষয়ে সরকারের যা দায়িত্ব, সরকার তা যথার্থভাবে পালন করছে। বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। সরকার গত নির্বাচনের সময়ও চেয়েছে, এখনো চাইছে-সব দল অংশ নিক। গত সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিএনপির চেয়ারপারসনকে ফোন করেছেন, নির্বাচনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিএনপি সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। তারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছে। এর জন্য সরকার বা নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।

তবে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারই শেষ ভরসা-এমন মত দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সংলাপ ও সংলাপে উঠে আসা বিভিন্ন প্রস্তাব প্রসঙ্গে সিইসির মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের দার্য়িত্ব কিছুটা বেড়ে গেল। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় ইসিকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচনে যেতে হবে; সে ক্ষেত্রে ইসিকে ক্ষমতা প্রয়োগের কতটুকু সুযোগ দেবে সরকার-তার ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা এমনও মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানের দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোরও। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরও দায়িত্ব রয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সিইসি সংবিধান অনুযায়ী ও সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে সংলাপে উঠে আসা প্রস্তাব গ্রহণ ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা বলেছেন, তা যথার্থ। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের দায়িত্ব বাড়ল। কারণ ইসি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে-তা নয়। সরকারেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইসি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করলেন, প্রধানমন্ত্রীরও উচিত হবে রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আবহ তৈরি করা। পাশাপাশি অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনে বিএনপির দায়িত্ব বাড়ল বলেও মনে করেই এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তার মতে, বিএনপির উচিত হবে যুক্তিসংগত কথাবার্তা বলা ও যুক্তির মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, সংবিধানের ১২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা সুস্পষ্ট করা আছে। সেখানে বলা আছে, ইসি যেভাবে চাইবে, সরকার তাকে সেভাবেই সহযোগিতা করবে। এটি সরকারের দায়িত্ব নয়; কর্তব্য। ফলে সরকারের প্রতি সবার নজর থাকবে। ইসি যথার্থই বলেছে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করবে। কারণ সংবিধানের ইসিকে সহযোগিতার কথা বলা আছে।

অবশ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা আশাবাদী বলে জানা গেছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও দলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এবার নির্বাচনে অংশ নিতে হবে বিএনপিকে। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। যেহেতু বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেহেতু নিবন্ধন ঠেকাতে হলে বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। তা ছাড়া গত তিন বছরে দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তৃণমূলেও ভীষণ বেকায়দায় দলটি। এর ফলে বিএনপি যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে-তা অনেকটাই নিশ্চিত।

আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, সরকারও চাইছে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হোক। সে জন্য বিশেষ রাজনৈতিক কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। একদিকে যেমন এ কৌশলের মূল লক্ষ্য পুনরায় ক্ষমতায় আসা; তেমনি সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিকে নির্বাচনে এনে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্ক এড়ানো। সে জন্য খুব সতর্কভাবে পা ফেলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমনকি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের প্রতিও এমন নির্বাচনের জন্য প্রস্ততি নেওয়ার নির্দেশও রয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইসি,জাতীয় সংসদ নির্বাচন,নির্বাচন কমিশন,রাজনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist