কলিহাসান, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)

  ১১ জুলাই, ২০২০

বন্দি ফুল মিয়া পাগল না ষড়যন্ত্রের শিকার!

নেত্রকোনার দুর্গাপুর

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে তিন বছর ধরে আবদ্ধ ঘরে শিকলবন্দি আছেন বৃদ্ধ ফুল মিয়া। এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছেন তিনি। এদিকে এলাকার এক জনপ্রতিনিধি বলেছেন ফুল মিয়া পাগল নয়, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে এই বৃদ্ধের এক ছেলে জানিয়েছেন তার বাবার মানসিক সমস্যা আছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের পিপুলনারী গ্রামে বৃদ্ধ ফুল মিয়াকে তিন বছর ধরে একটি নির্জন কক্ষে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। আটকে রাখা বৃদ্ধের খোঁজ নিতে ওই বাড়িতে প্রবেশ করে সাংবাদিকদের একটি টিম। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে সুরুজ আলী। শিকলবন্দি ফুল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমার কথাটি আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি পাগল নই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। আমাকে শিকলবন্দি করে পাগল বানানোর নাটক করা হচ্ছে। আমাকে পাগল বানিয়ে ঘরবন্দি করে রেখেছে সুরুজ আলী, মাওলানা রফিকুল ইসলামসহ আরো তিন থেকে চারজনের নাম উল্লেখ করে ২৫ মিনিট কথা বলেন তিনি। শিকলবন্দি দশা থেকে মুক্তি পেতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছেন এই বৃদ্ধ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফুল মিয়া মাটির নিচ থেকে ১৭ বছর আগে (ধাতব জাতীয়) মূল্যবান একটি পাথর খুঁজে পান। সেটি ২০০৩ সালে চৈত্র মাসের শুরুর দিকে। পাথরটি তার স্ত্রীর কাছে দেন লুকিয়ে রাখতে। ফুল মিয়া ওই পাথরটি বিক্রি করতে পার্টির খোঁজে বের হন। তিন পরে বাড়ি এসে স্ত্রীর কাছে পাথরটি চাইলে, তখন তার স্ত্রী বলেন পাথরটি সুরুজ মিয়া ও মাওলানা রফিকুলের কাছে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে স্বামী ঘরে থাকা দা দিয়ে স্ত্রীর গলায় আঘাত ঘটনাস্থলেই স্ত্রী ফাতেমা খাতুন মারা যান। ২০০৩ সালের বৈশাখ মাসের ৬ তারিখ এ হত্যার ঘটনা ঘটে বলে জানান বৃদ্ধের ছেলে আবু হানিফা। খবর পেয়ে পুলিশ ফুল মিয়াকে গ্রেফতার করে। নিহতের ভাই বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় ১২ বছর ৫ মাস ১৭ দিন জেল খাটেন ফুল মিয়া। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘদিন এলাকায় ঘোরাফেরা করেন। পরে পাথর বিক্রি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে বলাবলি করলে ক্ষেপে যান সুরুজ মিয়া ও রফিকুল ইসলাম। এরই জের ধরে ফুল মিয়ার ছেলেদের অসহায়ত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাবাকে শিকলবন্দি করে রাখার মত দেন সুরুজ আলী ও রফিকুল ইসলাম। এরপর থেকেই তিনি শিকলবন্দি। গত তিন বছরেও আলোর মুখ দেখেননি এ বৃদ্ধ।

শিকলবন্দি ফুল মিয়া জানান, ‘মাওলানা রফিক ও সুরুজ আলীর একসময় দিন আনতে পানতা ফুরাইতো। এখন শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ওই ধাতব জাতীয় পাথর বিক্রি করে আজ শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ওরা আমার সন্তানদের পুষ্য বানিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে রাখছে। আমি এ শিকলবন্দি থেকে মুক্তি পেতে চাই। এ পৃথিবীতে আমার সন্তানরা এত স্বার্থপর, বাবা হিসেবে আমি অভিশাপ দিয়ে গেলাম। তোদের কোনো দিন শান্তি হবে না’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

ফুল মিয়ার দুই ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। বৃদ্ধের ছেলে আবু হানিফা সাংবাদিকের এক প্রশের জবাবে এ প্রতিবেদককে জানান, বাবার মানসিক সমস্যা থাকার জন্য একঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। গত তিন বছর ধরে ঘরের খাটের সঙ্গে শিকল দিয়ে দুই পা বেঁধে রাখা হয়েছে। শিকলবন্দি অবস্থায় ঘর থেকে বারান্দা পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। ওই নির্জন কক্ষের ভেতরেই পায়খানা-প্রস্রাব করেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো সবই চলে ঘরের ভেতরে। মানসিক রোগী এ ব্যাপারে কোনো চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন বা কাগজপত্রাদি আছে কি-না আবু হানিফের কাছে জানতে চাইলে কোনো উত্তর মেলেনি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকের জানিয়েছেন, ফুল মিয়া মূলত পাগল না। তাকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে। এটা অমানবিক ঘটনা। তাকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার প্রশাসনের লোকদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। ফুল মিয়াকে আটকের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সুরুজ আলী সাংবাদিকের পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন। বন্দিদশার সঙ্গে ওপর অভিযুক্ত মাওলানা রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, আমি এ বন্দিদশার সঙ্গে জড়িত নই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম এ ব্যাপারে বলেন, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে শিকলবন্দি বৃদ্ধকে উদ্ধার করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close