আবু তাহের
মতামত
কে খুলবে এ জট!
১.
শুনেছি চুলের জট খোলা খুব কষ্টকর। একবার লাগলে অনেক সময় পেরিয়ে যায় এই জট খুলতেই। সমাধান কি চুল কেটে ফেলা! না, তা করে না কেউ। খুব ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে এই জট খুলতে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালিরা ধৈর্য্যশীল। ধৈর্যের শেষ সীমা পর্যন্ত আমাদের আনাগোনা। জটের দেশে বসবাস করে আমরা দিনকে দিন ধৈর্যশীল হয়ে উঠেছি।
যেমন যানজট। এটা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আজকাল যদি কোনো রাস্তা ফাঁকা থাকে তবে টনক নড়ে আমাদের। অনেকসময় ভয়ও জড়িয়ে আসে, কী ব্যাপার রাস্তা ফাঁকা কেন? কোনো সমস্যা হলো কিনা? আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই জটের সঙ্গে। এটা এখন মামুলি ব্যাপার। দীর্ঘসময় ধরে আমরা ধৈর্য ধরে বসে থাকি। কী এই কারণ? অনেক প্রশ্ন হয়েছে, অনেক কথাও হয়েছে। অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, অতিরিক্ত প্রাইভেটকারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেটকার। কোনো কোনো পরিবারের তিন-চারটি প্রাইভেটকার রয়েছে। কোনো কোনো সময় দেখা যায় প্রাইভেটকারে ড্রাইভার ও একজনমাত্র যাত্রী। একটি রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেটকার।
ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনা এতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ইচ্ছেমতো সিগন্যাল দেওয়াসহ তাদের নানান কর্মকা- যানজট সৃষ্টি ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ঢাকার রাজপথে ও ফুটপাথের বড় একটা অংশ অবৈধ দখলদারদের অধীনে রয়েছে। এই অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে পুলিশও জড়িত বলে অনেকের ধারণা। এটাও যানজটের একটা কারণ। যানজটের আর একটি কারণ হচ্ছে শহরের মধ্যে ট্রেন চলাচল। মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও এফডিসি ও সায়েদাবাদসহ ২০টি ক্রসিং পয়েন্টে প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন চলাচল করে। এতে প্রায় ৬ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে, ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া দেখা যায় যে, অনেক ফুটপাথ ভেঙে যাওয়ায় চলাচলের অযোগ্য হওয়ায় পথচারীরা বড় রাস্তায় নেমে আসে। ফলে গাড়ির গতি শ্লথ হয়। যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং ও গাড়ি ঘোরানো যানজটকে আরো তীব্র করে তুলেছে।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মেঘনা-গোমতী সেতুর পশ্চিমপ্রান্ত থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১০ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। আগের দিন রাত ১০টা থেকে পরদিন বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এ যানজট লেগেছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তাহব্যাপী এই যানজট লেগেই ছিল। জটের দেশে আমরা থাকি। যানজট নিরসনে অনেক লেখা হয়েছে অনেক কথাও হয়েছে। ওপরে যে সমস্যাগুলোর কারণে যানজট সৃষ্টি হয় সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে সঠিক সমাধান করলেই অনেকাংশে এই যানজট নিরসন সম্ভব। অন্যথায় বছরের পর বছর অনেক কথা হবে। আর সেগুলো হবে ফাঁকা বুলি আওড়ানোর মতো।
২.
যানজট মানুষের জীবনের কিছু মুহূর্ত কেড়ে নিলেও কিছু জট আছে, যা জীবনের বহু বছর কেড়ে নেয়। জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ঠেলে দেয় পড়ন্ত সময়ে। যেমন, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ফরিদ। দেখতে ছোটখাটো দিনমজুরি করা মানুষটিকে পরিচিতজনরা ডাকতেন ‘বাট্টি ফরিদ’ বলে। ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল হঠাৎ ওলটপালট হয়ে যায় তার জীবন। খিলগাঁও রেললাইনের পাশ থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয় তাকে। এরপর কোনো বিচার ছাড়াই অন্ধকার কারাগারে কেটে গেছে শ্রমজীবী মানুষটির জীবনের ৯টি বসন্ত। আপনজন বলতে কেউ নেই তার। তাই ৯ বছরে আদালতে একটি ওকালতনামাও দেওয়া হয়নি হতদরিদ্র ফরিদের পক্ষে।
গণমাধ্যমে জানা যায়, ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল বিকালে খিলগাঁও রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন ফরিদ। হঠাৎ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে খিলগাঁও থানায় নিয়ে যায়। পরে একটি ডাকাতি মামলায় সন্দেহভাজন গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে কোর্টে চালান করা হয়। আদালতে ফরিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় ওইদিন তার জামিনের আবেদন করা হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আদালত ফরিদকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই থেকে টানা ৯ বছর কাশিমপুর কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন ফরিদ। অবশেষে হতভাগ্য মানুষটির সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে মানবাধিকার সংগঠন ‘লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পারসন্স (এলএএইচপি)।’ তাদের সহায়তায় জামিনে মুক্ত হয়েছেন তিনি।
আইনের এই জট নতুন নয়, বহু পুরনো। এই জট খুলে আসতে পারে না ফরিদের মতো হতদরিদ্র মানুষ। জীবনের সোনালি সময়গুলো এভাবেই নষ্ট হয় তাদের। জটের দেশে বসবাস। তাই এই অনুভূতিগুলো আমাদের ছুঁয়ে যায় না। আমরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি সময়ের তালে। কিন্তু এর কি প্রতিকার নেই? দেশে অনিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই বাড়ছে বিনা বিচারে বন্দির সংখ্যা। যেমন সম্প্রতি ঢাকাতে বাবুল নামের একজনের সর্বোচ্চ সাজা ছিল ১৪ বছর, কিন্তু সে ২৫ বছর ধরে জেলখানায় বিনা বিচারে ছিল। পরে কোর্ট থেকে যখন মামলাটি ডিস্পোজাল হলো, সে নিরপরাধ হিসেবে খালাস পেয়ে গেল। বিনা বিচারে একটা মানুষ, সে তো দোষী হলো না কিন্তু তাকে এতদিন জেল খাটতে হলো। মানবধিকার লংঘনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ কী হতে পারে?
৩.
জটের দেশে বসবাস। কেউ জট না খোলায় দিন দিন জট বেড়েই চলছে। প্রত্যেকটি দেশের শক্তি হিসেবে ধরা হয় দেশের তরুণ সমাজকে। শিক্ষিত তরুণ সমাজ অগ্রগণ্য। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সময়ের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে তারাই আজই জটে আটকে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে পিছিয়ে পড়ছেন। যার ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষার্থীরা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চাকরি নিলেও শিক্ষাজীবনই শেষ করতে পারছেন না। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়ছে তাদের জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয় পক্ষ থেকে নানা সময়ে নানা রকম আশার বাণী শোনানো হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সেশনজটের খপ্পরে পিছিয়ে রয়েছে অধিভুক্ত এসব শিক্ষার্থী। আর এই জটের কারণে শিক্ষার্থীদের অনার্স এবং মাস্টার্স করতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়। যার ফলে চাকরিতে আবেদনের বয়স প্রায় শেষ হয়ে আসে। কিন্তু এই জটের কারণে তাদের ফিরে পাওয়া সম্ভব হয় না সোনালি সময়গুলো। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিভিন্ন অনুষদের বেশির ভাগ বিভাগে ভয়াবহ সেশন জট রয়েছে। সেশন জট বাড়তে বাড়তে এখন এক থেকে দেড় বছরে পৌঁছেছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে পাঁচ বছরে শেষ হওয়ার কথা। অথচ ছয় বছরেও কোর্স শেষ করতে পারছে না বিভাগগুলো। এ সংকটের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতাই মূল হিসেবে ধরা যায়। এ সম্পর্কে ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, অনেক শিক্ষক স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগে বছরের শেষে ক্লাস শুরু করেন, শেষও করেন সবার পর। ফলে জট লেগে যায়। তিনি আরো বলেন, কিছু বিভাগ সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় এ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসন এ কোর্সের অনুমতি দিয়ে থাকলেও বিভাগগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও উদাসীনতাতেই সেশন জট বেড়েছে।
৪.
আবুল হোসেন লঞ্চের পাটাতনে শুয়ে আছে। চোখ দুটো বুজে আছে। ঘুমিয়ে আছে কি না, বোঝা মুশকিল। লঞ্চটি মনে হচ্ছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। থেমে আছে মনে হচ্ছে। কি হলো, ইঞ্জিন নষ্ট নাকি অন্য কিছু? সারি সারি লঞ্চ থেমে আছে চাঁদপুরের মোহনায়। নদীর ছলাৎ পানি এসে লাগছে লঞ্চের গায়ে। কিন্তু এত লঞ্চ কেন? কারণ আর কিছুই নয়। লঞ্চগুলো জ্যামে পড়েছে। নৌ ট্রাফিক কোথায় যেন গেছে চা খেতে। সিগনাল পাল্টাতে ভুলে গিয়েছে। এই ফাঁকে চাঁদাবাজরা এসে লঞ্চে লঞ্চে চাঁদা তুলছে। ধরিয়ে দিচ্ছে টিকিট, ইজারার টিকেট। এই জট কখন খুলবে। নদীতেও জ্যাম। হঠাৎ আবুল হোসেনের লঞ্চটি কেঁপে ওঠে। ধরফর করে উঠে বসে আবুল হোসেন। চোখ কচলে বাইরে তাকায়। লঞ্চঘাট দিয়েছে। আবুল হোসেন এদিক-ওদিক ভালো করে তাকায়। কোথায় জ্যাম। নদীতো ফাঁকা। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? তাই হবে হয়তো। আবুল হোসেন ভাবে, কোনো একদিন হয়তো এই নদীতে যানজট লাগবে। কে খুলবে সে জট?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
[email protected]