প্রতীক ইজাজ

  ৩১ অক্টোবর, ২০১৮

কাঙ্ক্ষিত সংলাপ আগামীকাল

আগামীকাল সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ডেকেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় এই সংলাপ শুরু হবে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেনকে পাঠানো এক চিঠিতে সংলাপের এই সময় জানানো হয়। এর ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই প্রথম ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের কোনো সংলাপ হতে যাচ্ছে।

গতকাল সংলাপের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে ড. কামাল হোসেনকে একটি চিঠিও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকালে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ওই চিঠি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসায় পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতে সংলাপে আমন্ত্রণের পাশাপাশি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ২৮ অক্টোবর চিঠি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

নির্বাচনী ক্ষণগণনার ঠিক আগের দিন গত সোমবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে সম্মতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেন। প্রধানমন্ত্রী এমনও জানান, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে সংলাপ হবে শর্তহীন। তিনি নিজেই সংলাপের নেতৃত্ব দেবেন। এর আগে গত রোববার শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে সব দলের অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ চেয়ে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে পৃথক চিঠি দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। সেই চিঠির বিষয়ে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনা হয়। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী সংলাপের বিষয়ে সাড়া দেন।

সংলাপকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের স্বস্তি দেখা দিয়েছে। জন্মও দিয়েছে নানা আলোচনার। সংলাপের ফলের দিকে তাকিয়ে সবাই। কী আলোচনা হয় সেখানে—সেদিকে যেমন আগ্রহ; আবার সংলাপকে কার্যকর করতে উভয় পক্ষ কতটুকু ছাড় দিতে পারে তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে এই সংলাপ কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে সেই বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে এরই মধ্যে।

এরই মধ্যে সংলাপে বসার সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কূটনীতিকরা। তবে বিএনপি সংলাপের ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। সংলাপের ঘটনাকে দেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, এর মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চলমান রাজনীতিতে যে ধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে তা দূরীকরণ এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম হওয়ার প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। তারা সংলাপ অর্থবহ করার জন্য সব পক্ষকেই সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার আহ্বান জানান।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এ সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি বর্তমান রাজনীতি জন্য ইতিবাচক। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুভচিন্তার রাজনীতির পথে অনেক দূর যাওয়ার পথ তৈরি হতে পারে। এ কারণেই বৈঠকটি অত্যন্ত মূল্যবান। সার্বিকভাবে বলা যায়, এটা একটি শুভসূচনা। প্রত্যাশা থাকবে বৈঠকটি ফলপ্রসূ হবে এবং আগামীতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথও উন্মোচিত হবে এ বৈঠক থেকে।

প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণপত্রে কী লেখা আছে : সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ড. কামাল হোসেনকে পাঠানো আমন্ত্রণপত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন—‘সালাম ও শুভেচ্ছা নিবেন। আপনার ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখের পত্রের জন্য ধন্যবাদ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। তাই আলোচনার জন্য আপনি যে সময় চেয়েছেন সে পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ০১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় আপনাকে আমি গণভবনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রীর প্যাডে লেখা চিঠির শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষর রয়েছে।

কী ভাবছে আওয়ামী লীগ : সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন সংবিধানের মধ্যে থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই সংলাপ সহযোগিতা করবে। সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা আলোচনা হবে। এ ব্যাপারে গতকাল দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারি দলের সংলাপে খোলামেলা আলোচনা হবে। তবে ঐক্যফ্রন্টের বাইরে এই মুহূর্তে অন্য কোনো দলের সঙ্গে সংলাপের সুযোগ নেই বলেও জানান এই নেতা।

তবে সংলাপ কোনো বিদেশি চাপে হচ্ছে না তা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মমর্যাদাশীল একজন ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশকে তিনি একটি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তিনি কোনো বিদেশি চাপে নত হওয়ার মতো মানুষ নন। তারপরও আমি বলব, বিদেশি কোনো চাপ ছিল না। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কোনো সমস্যা নেই, বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে চলছে। সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশে এই সরকার কোনো কিছুই করেনি এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা সংবিধান সম্মত যে কাজ, আমরা সেই কাজ করে যাব।’

সংলাপ নিয়ে কী ভাবছে ঐক্যফ্রন্ট : ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই বলে আসছে এই জোটের দফাগুলো সাংবিধানিক নয়। মানা সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংলাপ হতে যাওয়ায় ঐক্যফ্রন্ট অনড় না থেকে খোলা মনে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোটের নেতারা মনে করছেন আলোচনার টেবিলে নিশ্চয় নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। ৭ দফা বা অন্য কোনো বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা সংলাপ চেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দিয়েছেন। তার মানে আমরা সবাই চাই অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন। আলোচনার টেবিলে অনেক সংকটের সমাধান হয়। আশা করছি আমরা যেসব দফা উত্থাপন করেছি, সেখানেও সমাধান মিলবে।

ঐক্যফ্রন্ট নেতারা মনে করছেন, শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তি এই দাবি ছাড়া অন্য সব দফা বিবেচনা করার মতো। এখানে ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি বিএনপিরও গণতান্ত্রিক মনোভাব থাকতে হবে। বিএনপিকেও এ সংলাপে নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। এজন্য সংলাপে বিএনপিসহ সব দলকে খোলা মনে আলোচনা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, শুধু ৭ দফা নয়, অন্যান্য বিষয় ও বর্তমান যে বিষয়গুলো আছে অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রাসঙ্গিক সব বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করব। দেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব।

গণফোরামের এই নেতা আরো বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো সাহায্য সহযোগিতা আমাদের কাছে চান অবশ্যই ড. কামাল হোসেন সাহেব বিস্তারিত কথা বলতে পারবেন। যেহেতু উনি সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম, উনি এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাটা দিতে পারবেন। এ বিষয়টি আমরা উনার ওপরে ছেড়ে দিচ্ছি, উনি সংলাপের নেতৃত্ব দেবেন।

মুখর রাজনীতি, নানা মহল : সংলাপ নিয়ে মুখর এখন দেশের রাজনীতি। সংলাপের খবর প্রচার হওয়ার পর থেকেই সংলাপের নানা দিক নিয়ে কথা বলছেন দেশের রাজনীতিকরা। সংলাপের ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আপিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির ফলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংলাপে দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই নেতা জানান, দলের অবস্থান হবে সাত দফা দাবি। একটাই অবস্থান। এর বাইরে কোনো অবস্থান নেই।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সংলাপে বসার খবরকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখলেও এই সংলাপ যেন দুই পক্ষের ‘ক্ষমতা ভাগের’ জন্য না হয়—সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গতকাল রাজধানীতে এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা ৬০-৪০ ভাগাভাগির সংলাপ যেন না হয়, সংলাপ হতে হবে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সংলাপের ফল ইতিবাচক হবে বলে আশাবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতের পর সংলাপ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী।’

ঐক্যফ্রন্টের যারা যাচ্ছেন সংলাপে : বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠেয় সংলাপে অংশ নিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৬ সদস্যের একটি দল নির্ধারণ করেছে। এ ব্যাপারে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব জানান, ড. কামাল ছাড়া ১৫ জনের একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেবে। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে অনুষ্ঠিক এক বৈঠকে নামগুলো চূড়ান্ত করা হয়।

গণভবনের সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধিদলে দলনেতা হিসেবে থাকবেন ড. কামাল হোসেন। সংলাপে অংশ নেবেন বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস; নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম, গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির আ স ম আবদুর রব, আবদুল মালেক রতন ও তানিয়া রব এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও আ ব ম মোস্তফা আমিন। এছাড়া স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংলাপ,রাজনীতি,আওয়ামী লীগ,জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close