প্রতীক ইজাজ

  ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

খালেদা জিয়া কারাগারে

আওয়ামী লীগের সতর্ক পর্যবেক্ষণে বিএনপি

দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে। এ নিয়ে নানা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিতে। দুই দলেই স্বস্তি-অস্বস্তি দুটোই রয়েছে। সতর্ক দুই পক্ষ। আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপিকে কড়া পর্যবেক্ষণ করছে; তেমনি বিএনপিও বিশেষ কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে এই ইস্যু নিয়ে দুই দলেই রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল, লাভ-লোকসানের হিসাব।

দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা কেন্দ্র করে বিদ্যমান রাজনীতিতে তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে বিএনপি কী ধরনের কর্মসূচি নিতে পারে এবং মুখে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বললেও অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা কী-সেটা বুঝে পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করবে দলটি। সে জন্য এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থেকে বিএনপিকে পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য খালেদা জিয়ার সাজা কেন্দ্র করে দলীয় নেতাদের সতর্ক ও কম কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।

বিশেষ করে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় এই ইস্যুতে বিএনপি জনগণের সহানুভূতি পেতে পারে—এমন কোনো বক্তব্য বা আচরণ করা যাবে না বলে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি নেতাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা বা উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহার করতেও নিদের্শ দিয়েছেন তিনি।

এমন সতর্কতার অংশ হিসেবে রায় ঘোষণার পরপরই এক প্রতিক্রিয়ায় সেতুমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের রায় নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাতে নেতাকর্মীদের বারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার নয়, রায় দিয়েছেন আদালত। নেতাকর্মীদের বলব, এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। মারামারি, লাফালাফি, দাপাদাপির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা ঠান্ডা মাথায়, সতর্কভাবে, রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করব।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘বিএনপি সামনে কী পদক্ষেপ নেয় সেটা দেখার বিষয়। সেই রকম সময় এলে পরিস্থিতি বুঝেই রাজনৈতিক কৌশল নেওয়া হবে। তবে এটা ঠিক যে, অস্তিত্বের প্রয়োজনে বিএনপির কিছুটা জ্ঞান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন না করে যে ভুল হয়েছে সেটা তারা বুঝতে পেরেছে।’

আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার সাজা কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো। দল মনে করছে, আদালত দুর্নীতির দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেওয়ায় স্বস্তিতে আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে দলের প্রধান দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে পেছনে ফেলার জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হিসেবেই দেখছেন ক্ষমতাসীনরা। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার ‘দুর্নীতিবাজ’ বিষয়টি ভোটারদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টসহ আরো কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত ভাইস-চেয়ারম্যান হওয়ায় এ নিয়ে দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।

সাজার কারণে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না-তা এখনো নিশ্চিত নন কেউই। যদি না পারেন, সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না-তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দলের ভেতর ও বাইরে পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র চাপের মুখে পড়বে দলটি। সে ক্ষেত্রে দলে ভাঙা-গড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। খালেদার সাজার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সুবিধা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, এই সাজার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী রাজনীতি ও প্রচারণায় প্রতিপক্ষদের চেয়ে বেশি সময় ও সুযোগ পাবে। কারণ খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে আইনগত দিক ও আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকবে দলটি। এ ছাড়া তারেক রহমানকে নিয়ে দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ দেখা দিলে তা মেটাতেও সময় যাবে দলের নেতাদের। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দিলে-দলের ভাঙন ঠেকাতেও হিমশিম খেতে হবে বিএনপিকে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের চেয়ে দল নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটবে দলের নীতিনির্ধারকদের। তখন নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে থাকবে ক্ষমতাসীনরা।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি যে একটি নষ্ট-পরাস্ত রাজনৈতিক দল, তা তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে প্রমাণ করেছে। বিএনপি সুস্থ চিন্তা করতে পারে না। তারা যে সুস্থ মানসিকতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী না, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

দলীয় সূত্রমতে, সাজা আদালত দিয়েছেন। মামলাটিও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার। সুতরাং এখানে বর্তমান সরকারের কোনো হাত নেই। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা নিয়ে এগোলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সে জন্য দলকে খুবই কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে দলের নেতারা মনে করছেন।

অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার মামলার রায় পূর্ব, রায়ের দিন ও রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও ক্ষমতাসীনরা সফল বলে মনে করা হচ্ছে। দলের নেতারা মনে করছেন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং একটা বড় দলের প্রধানকে কারাগারে পাঠানোর পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় কোনো অবনতি হয়নি। এটা বড় স্বস্তির বিষয়। আদালতের রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভালোভাবে বাস্তবায়ন করেছে। এ সময় দলীয় নেতাদের সতর্ক মন্তব্য ও সংযত আচরণ এ রায় যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা প্রমাণ করতে পেরেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ আরো কিছু সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে চায়। এরপর পরিস্থিতি বুঝে নতুন বা পুরনো কৌশল নেবে দলটি। আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা, যতই অহিংস কর্মসূচির কথা বলা হোক, বিএনপি সে অবস্থানে থাকতে পারবে না। নির্বাচনের এখনো প্রায় ১০ মাস বাকি। তার আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনতে হবে। সে জন্য ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ছাড়া আরো কয়েকটি মামলা এখনো বিচারাধীন। সেসব মামলার রায়ও নির্বাচনের আগে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ চট করেই কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে না। সতর্ক অবস্থানে থাকলে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

দলের নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে সারা দেশে নির্বাচনী রাজনীতি শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিভাগীয় শহরে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্য দলগুলোও যখন নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, বিএনপি তখন আদালতপাড়ায়। এসব কারণে আগামী নির্বাচনে বিএনপির থেকে অনেকগুণ বেশি এগিয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিএনপির এ দুর্বলতাকে ষোলোআনা কাজে লাগানোর ইচ্ছা রয়েছে আওয়ামী লীগের।

তা ছাড়া খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দুর্নীতিবাজ-এটা আদালতে প্রমাণ হওয়া জরুরি ছিল, তা হয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে-বিদেশে এটা প্রচারের যথার্থ সময়। বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে এখন কঠিন সময় পার করতে হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির চেষ্টা ছাড়াও একদিকে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, অন্যদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়াটা বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য ব্যস্ত থাকতে হবে নেতাদের। ফলে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায় ও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়বে বিএনপি।

তবে এই সাজার ফলে খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যাচ্ছে কি না, সে নিয়েও দলের মধ্যে একধরনের ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন দলের নীর্তিনির্ধারকদের কয়েকজন। সে জন্য এখনই রায়ের প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বেশি উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। দলের নেতারা মনে করছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে, এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ জন্য দলের উচ্চপর্যায় থেকে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এমন মনোভাব সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে জেল খেটে মানুষ বড় নেতা হতেন। কারণ, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক মামলা। কিন্তু খালেদা জিয়া তো দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত। সহানুভূতি পাবে কেন?’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্নীতির মামলা,আওয়ামী লীগ ও বিএনপি,কারাগারে খালেদা জিয়া
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist