শ্রীধর দত্ত

  ১৫ জুলাই, ২০১৯

শঙ্খ নদী ও আমার ছেলেবেলা

শঙ্খ নদীর অফিশিয়াল নাম সাঙ্গু। প্রাচীনকাল থেকে এটিকে সবাই শঙ্খ নদী বলে। বাংলাদেশের বান্দরবানের সীমান্তবর্তী থানচি থানার মদক নামক পাহাড় থেকে শঙ্খ নদীর উৎপত্তি। শঙ্খ নদী পাহাড়ের কোল থেকে নেমে বান্দরবান ও চট্টগ্রাম বিস্তীর্ণ গ্রাম আঁকা বাঁকা পথে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। প্রাচীন সভ্যতার মিশর যেমন নীলনদের দান ঠিক তেমনি দক্ষিণ চট্টগ্রাম শঙ্খ নদীর দান। রূপবতী শঙ্খ দু’ধারে সবুজের পাহাড়। প্রতি বছর শঙ্খ নদী বর্ষা মৌসুমে বন্যায় পলি পড়ে উভয় কূলের মাটি উর্বর হয়, ফলে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ তরিতরকারি উৎপাদন হয়। শঙ্খ নদীর পাড়ের টাটকা সবজি দোহাজারী থেকে সড়ক ও রেলপথে চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। শঙ্খ নদীতে অনেক জেলে মাছ ধরার মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ ছাড়া নদীর দুই তীরের মানুষ যেমন সুফল পায় ঠিক তেমনি বর্ষা মৌসুমে প্রলয়ংকারী বন্যায় ঘর বাড়িও হারাতে হয়। শঙ্খ নদীতে বৈতরণী, ধর্মপুর, কাঠগর, দোহাজারী, নলুয়া, আমিলাইশ, চরতি ও চানপুর লক্ষ মানুষের স্বার্থ জড়িত।

কথিত আছে শঙ্খ নদীরা নাকি সাত বোন। প্রবাদ আছে "মরা গরু জিয়ি গিয়ে শঙ্খ নদী ফিরে গিয়ে"। কাহিনীটি এরকম-শ্রাবণের কোন এক ঘন বর্ষণের ভোরে খরস্রোতা প্রলয়ঙ্করী শঙ্খনদী দিঘীতে ঢুকবে পণ করে প্রবল বেগে আঁছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মঠের ধ্যানাসনে উপবিষ্ট শ্রী শুক্লাম্বর হাতে কমন্ডলুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন এ প্রবল স্রোতের মুখে। তিনি দিঘীর জল অপবিত্র হবে ভেবে নদীকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। নদীর জল দিঘীতে ঢুকলে দিঘীর জল অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিল একটি মরা গরু। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে এ সাধক হাতের কমন্ডলুর জল ছিটিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মরা গরুটি। প্রাণ ফিরে পেয়ে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল উঁচু ডাঙায়। মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল উমত্ত জলরাশি। জল থেকে উঠে এসেছিলেন মকর বাহনা গঙ্গা। তিনি বর দিয়েছিলেন যে শঙ্খ নদীর জল কোনদিন দিঘীতে প্রবেশ করবে না। স্থানটি চন্দনাইশের বরমায় শ্রী শুক্লাম্বর দিঘী নামে সুপরিচিত।

এক সময় এই শঙ্খ দিয়েই ছুটে যেতো রঙ্গিলা মাঝির সাম্পান আঞ্চলিক গানের মুকুটহীন সম্রজ্ঞী শিল্পী শেফালী ঘোষের কন্ঠে

‘পালে কী রং লাগাইলরে মাঝি

সাম্পানে কী রং লাগাইল

শঙ্খ খালর সাম্পানওয়ালা আঁরে

পাগল বানাইল...’

বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে শঙ্খ নদীর রুদ্ধ ভয়ঙ্কর রূপ আমি শৈশব কালে দেখেছি। এখন পত্রপত্রিকায় শঙ্খ নদীর পাড় ভাঙ্গন এবং দুই পারে বন্যার ছবি দেখলে সে ছেলে বেলার কথা মনে পড়ে যায়। দোহাজারীর শঙ্খ নদী ব্রীজের দক্ষিণ পাড়ে ১০০ মিটার দূরে অবস্থিত সাঙ্গু ভ্যালি টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ যেটি বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের একটি প্রতিষ্ঠানের একটি শাখা প্রতিষ্ঠান। সবাই এই ইন্ডাস্ট্রিকে ইস্পাহানি নামে চিনে ও জানে। হয়তো অনেকে চিনবেন দোহাজারী দক্ষিণ দিকে ব্রিজের ১০০ মিটার পর ডান পাশে সিএনবি এবং বাম পাশে অবস্থিত ইস্পাহানি। আমার বাবার চাকরির সুবাদে আমাদের পরিবার ইস্পাহানির ভিতরে কোয়াটারে বসবাস করতাম। আমাদের পৈত্রিক বাড়ি পটিয়ার মেলঘর গ্রামে বড়দা দত্তের বাড়ি। আমার দাদু ব্রিটিশ আমলে বন বিভাগের চাকরি করতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে শুধুমাত্র আমার জন্ম হয়েছিল দোহাজারীতে। বাবা চাকরিতে কখন যোগদান করেছেন তা জানিনা, তবে ঠাকুর মার কাছে শুনেছি পাকিস্তান আমলে মাসিক বেতন ছিল ৩০ টাকা। যখন আমি বুঝতে শিখি তখন আমার বাবা ক্যাশিয়ার এবং পরবর্তীতে সহকারি ম্যানেজারে পদোন্নতি হয়। আমার কাকাও ইস্পাহানীতে চাকরি করেছিল। তবে তিনি ১৯৮২ সালে সপরিবার ভারতের শিলিগুড়িতে চলে যান।

পূর্ব কাটগড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি ক্লাস টু কিংবা থ্রি তে পড়ি মনে হয় ওই সময় শঙ্খ নদীর ভাঙ্গনে বিদ্যালয়টি বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয় জয়নগরের পূর্ব পাশে। প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যার (সিদ্দিক স্যার), নতুন স্যার এবং হুজুর স্যারের কথা মনে পড়ে। প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে দোহাজারী জামিজুরী আব্দুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। আমি ভর্তি হবার পূর্বেই আমার তিন ভাই উক্ত স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করে বের হয়। ভাইদের সুপরিচিতির কারণে শিক্ষকরা আমাকে খুবই স্নেহ করতো। মনে পড়ে সুভাষ স্যার,আহমেদ স্যার, মিলন স্যার, ফারুকী স্যার ও পন্ডিত স্যারের কথা। হাই স্কুল যখন আসা যাওয়া করতাম তখন মনে পড়ে রাস্তায় দ্রুততম কোস্টার ছিল লাল বোর্ড ও সাদা বোর্ডের কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্লাস সেভেনে উঠার পর ১৯৯০ সালে বাবার কাপ্তাই বদলির কারণে দোহাজারী ছেড়ে চলে আসতে হয়। সে সময় টানা ৪-৫ দিন বৃষ্টিতে বর্ষা মৌসুমে শঙ্খ নদীর পানি বেড়ে গেলে আমাদের ঘরে হাঁটুর উপরে পানি উঠতো। ঘরের আসবাবপত্র খাট ইটের উপর ইট দিয়ে উপর করতে হতো। পানি ওটা যেমন কষ্টকর ঠিক তেমনি পানি নেমে যাওয়ার পরের পরিষ্কারের সময় গুলো বড়ই যন্ত্রনাদায়ক। ইস্পাহানীর গেটের সামনে সকালে বাজার (ব্যায়ান বাজার) বসতো। তখন তরিতরকারি মাছ সব কিছু টাটকা ও সস্তা ছিল। এক কথায় ৫০ টাকায় তলে ভরে বাজার করা যেতো। বন্ধু মান্নানের বাবা (হাফেজ সাব হুজুর) ও মা আমাদেরকে নিজ ছেলের মতো আমাদের সব ভাইকে ভালোবাসতো। ভালোবাসা মুখে নয় কাজে প্রমাণ পাওয়া যায়। চাচি (মান্নানের মা) আমার ভাইয়ের কোন একটা বিষয়ের জন্য একদিন রোজাও থেকেছেন। কাজের জন্য বাবাকে মাসে ২/১ বার কাপ্তাই কিংবা বাগেরহাটে যেতে হতো। আসার সময় খবর ওখান থেকে বড় (১২-১৫) কেজির মাছ নিয়ে আসতো এবং মাছটি কেটে কোয়াটারের সবার মাঝে ভাগ করে দিতো। বয়স্করা যখন আমাকে সিগারেট আনতে দিতো তখন নামটা মনে থাকত না ,তাই বারবার মুখে বলে বলে নিয়ে আসতাম। আমাদের অসুখ হলে বিওসির মোড়ে ডাঃ বরদা (হোমিওপ্যাথিক) থেকে ওষুধ খেতাম। তখন আমাদের গণ্ডি ছিল বিওসির মোড় থেকে দোহাজারী পর্যন্ত।

ইস্পাহানিতে একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। সেখানে দোহাজারী ও কালিয়াইশের অনেক ফুটবলার ফুটবল খেলতে আসতো। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের বশির, আজগর দোহাজারী থেকে ইস্পাহানীর মাঠে নিয়মিত খেলতে আসতো। ওদের কাছ থেকেই আমাদের খেলার উৎসাহ। আমি, আব্দুল মান্নান, লোকমান, দিল মোহাম্মদ সহ আরো কয়েকজন মিলে ফজরের নামাজের পরই ঘুম থেকে উঠে যেতাম। যে সবার আগে উঠতো সে সবাইকে জাগিয়ে তুলতো এবং আমরা মাঠে ফুটবল খেলতাম এবং মাঝেমধ্যে শঙ্খ নদীর পাড়ে ব্যায়াম করতে যেতাম। শঙ্খ নদীতে সপ্তাহে ২-৩ দিন দলবেঁধে স্নান করতে যেতাম। শঙ্খ নদীতে ছিল আমাদের বিনোদনের খোরাক। পাহাড় থেকে নদীতে বাঁশের ভেলা আসত এক কিলোমিটারের উপরে লম্বা লাইন। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে শঙ্খ নদীতে পাহাড় থেকে গাছ গাছালি ডালপালা ভেসে আসতো এবং মোটা দড়ির সাহায্যে আংটা বানিয়ে কাঠ সংগ্রহ করতো। অনেকে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে বড় গাছ সংগ্রহ। ইস্পাহানিতে বিনোদনের জন্য একটি ক্লাবঘর ছিল। ২৪"" রঙিন টেলিভিশন ছিল। আমার মনে পড়ে ভোর তিনটায় বাবা ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ দেখেছিলাম। সে সময় আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ নিয়েছিল। মনে পড়ে ঐতিহাসিক মুহূর্ত ১৯৮৯ সালের ৩০ মে বাংলাদেশের লাল দল দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে ছিল। ঠাকুর দিদির সাথে নৌকা করে দিয়াকুল আশ্রমে গিয়েছিলাম। ইস্পাহানীর দক্ষিনে জয়নগর (রক্ষিত বাড়ি) এবং কালিয়াইশে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। লাটিম, মার্বেল, সাত ছাড়া, ভলিবল, ফুটবল খেলেছি সে সব স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়। বন্ধু যীশু, বাপ্পা, রুপম,সুজন, লিটন আরো অনেকে নামগুলো সম্ভবত এখন আর মনে পড়ছে না। শুনেছি ২০০০ সালের দিকে এ ইস্পাহানি বিক্রি করে দিয়েছে। সুদীর্ঘ ৩০ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল বর্তমানে আমি প্রবাসী। দেশে গেলে আমি একবার করে ঘুরে আসি সেই শঙ্খ নদীর তীর দোহাজারী। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে জনবসতিও অনেক বেড়ে গেছে। তখন যে রকম বন্যায় শঙ্খ নদীর ভয়াল রূপ দেখেছি এখন হয়তো কম হবে না। তাই শঙ্খ নদী ও দোহাজারী আমার অস্তিত্বে, আমার নাড়ির টান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন কপোতাক্ষ নদের বারি পানে তৃপ্তি লাভ করেছিল ঠিক তেমনি আমিও আমার শঙ্খ নদীর বারি পানে পরিতৃপ্তি অনুভব করি। তাই কবির ভাষায় বলি-

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!

বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে

দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শঙ্খ নদী,ছেলেবেলা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close