গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

এলোমেলো নদীর গতি

যত্রতত্র অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ফলে এলোমেলো হয়ে গেছে দেশের নদ-নদীর গতি-প্রকৃতি। নদীর চিরায়ত ধর্মকে (গতিপথ) আমলে না নিয়ে পরিকল্পনা করায় দেশব্যাপী নৌচলাচলে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের শৈথিল্যে ঘটছে এই নীতিমালা লঙ্ঘনের ঘটনা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এই কাজটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি পক্ষ সম্পৃক্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরসহ (এলজিইডি) সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষের অনেকেই। এমনকি বিদ্যুৎসংযোগ লাইন বিতরণ কর্তৃপক্ষও এই নীতিমালা লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অসংখ্য ব্রিজসহ জলপথের ওপরে নানা স্থাপনা গড়ে ওঠার পরে বিলম্বে হুঁশ ফিরেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। এখন নদী রক্ষায় কর্তৃপক্ষ নেমে পড়েছে কোমরবেঁধে। নদীকে বাঁচাতে নতুন করে বিন্যাস হচ্ছে নৌপথের শ্রেণিবিন্যাস। চলছে ভারটিক্যাল অ্যান্ড হরাইজনটাল ক্লিয়ারেন্স (উল্লম্ভ এবং আনুভূমিক পরিমাণ) পুনর্বিন্যাসের।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরনো আমলে নির্ধারণ করা নৌপথের চার শ্রেণিবিন্যাসকে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এতে তৃতীয় শ্রেণির নদীকে ১ম শ্রেণির নৌপথে উন্নীত করা হয়েছে। এমন নৌপথের সংখ্যা ৩১টি। একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির (৩য় শ্রেণির ১৪টি এবং ৪র্থ শ্রেণির ২২টিসহ) ৪৯টি, তৃতীয় শ্রেণির ১০টি এবং ৫টি নৌপথকে চতুর্থ শ্রেণির নৌপথের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই কাজটি করতে ‘অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১০ নামে প্রণীত বিধিমালায় নতুন বিন্যাস করা নৌপথকে সংযোজন করার সুপারিশ রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ বলেছেন, জলপথের যানগুলো নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য নদীর ওপর নির্মিত স্থাপনাগুলো (ব্রিজ কিংবা বিদ্যুৎসংযোগ লাইন) বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমতি নিয়ে করতে হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে নির্মিত অনেক ব্রিজ এসব নিয়ম মানেনি। ফলে নদীর ভারটিক্যাল অ্যান্ড হরাইজনটাল ক্লিয়ারেন্স ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে জলপথের ওপর স্থাপনা নির্মাণের ফলে নদীর গতিপথে গরমিল হয়ে গেছে। কারণ ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্যয় কমাতে গিয়ে নৌপথের গতিপথের ধ্বংস ডেকে এনেছে। ফলে নতুন করে নৌপথের শ্রেণিবিন্যাস হালনাগাদ করা হচ্ছে, যাতে জলপথের ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারটিক্যাল অ্যান্ড হরাইজনটাল ক্লিয়ারেন্স (উল্লম্ভ ও আনুভূমিক পরিমাণ) ঠিক থাকে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। এতে কোন নদী কোন শ্রেণির তা ক্যাটাগরিক্যালি নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে যে কেউ চাইলেই নিজেদের সুবিধামতো ব্রিজ কিংবা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করতে পারবেন না, যোগ করেন সচিব।

আর বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, নদীর ওপর স্থাপনা গড়ে তোলার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কেউ অনুমতি না নিয়ে জলযানের ওপর স্থাপনা করলে তার পুরো দায় ওই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে, যোগ করেন টিএর চেয়ারম্যান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ জলপথে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারটিক্যাল ও হরাইজনটাল ক্লিয়ারেন্স-সংক্রান্ত ‘অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১০ প্রণয়ন করেন। এ বিধিমালায় অভ্যন্তরীণ জলপথকে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণির জলপথের সংজ্ঞা, জলপথের ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে আনুভূমিক এবং উল্লম্ভ ছাড়ের পরিমাণ কত হবে তা বিধিতে স্পষ্ট করা হয়। কিন্তু প্রণীত বিধিতে দেশের বিদ্যমান জলপথগুলোকে সুস্পষ্টভাবে শ্রেণিবিন্যাস না করায় জলপথের ওপর স্থাপনা (ব্রিজ, বিদ্যুৎ লাইন ইত্যাদি) নির্মাণকারী সংস্থাসমূহের নির্মাণ ব্যয় কমাতে ছাড় দেয় নৌ মন্ত্রণালয়। বিধি বাম। এতেই সুযোগ বুঝে এলজিইডিসহ অনেকে জলপথের ওপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী, ব্রিজ নির্মাণ করে। ফলে এলোমেলো হয়ে যায় নৌপথ। এই পথে চলাচল করা নৌযান নির্বিঘ্নে চলতে পারছে না। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় নদীর নাব্য সংকট কাটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নৌ মন্ত্রণালয় বলছে, যত্রযত্র ব্রিজ ও বিদ্যুৎ লাইন নদীর ওপর স্থাপনে উল্লম্ভ ও আনুভূমিক পরিমাণ ধরে রাখা তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

এখন নতুন করে নদী বাঁচাতে নৌপথের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। নৌ মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৭ সদস্যের কমিটি নৌপথকে নতুনভাবে বিন্যাস করে বিদ্যমান ৩১টি (২য় শ্রেণির ১২ ও ১টি ৩য় শ্রেণির) নৌপথকে ১ম শ্রেণির, ৪৯টি নৌপথকে ২য় (১৪টি ৩য় ও ২২টি ৪র্থ) শ্রেণির এবং ১৫টি নৌপথকে ৩য়-৪র্থ শ্রেণির করা হয়েছে। বাকি সব নদীর ওপর স্থাপন করার আগে জলযান বিধির ৩ বিধি অনুসরণ করার নির্দেশনা দিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়।

কমিটির সুপারিশ করা উল্লেখযোগ্য প্রথম শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নৌপথ হচ্ছে—বুড়িগঙ্গা চীন মৈত্রী সেতু-১ এর ভাটি হতে চট্টগ্রাম (সদরঘাট) আমানত শাহ রোড ব্রিজের ভাটি পর্যন্ত, শম্ভুপুরা-কাঁচপুর (রোড ব্রিজের ভাটি পর্যন্ত), শম্ভুপুরা-ভৈরববাজার (রেলওয়ে ব্রিজের ভাটি পর্যন্ত), আজাদবাজার-বরিশাল-ঝালকাঠি-কাউখালী-রামপাল- মোংলা-খুলনা-মহেশ্বর-পাশা, চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার (ভায়া-কুতুবদিয়া চ্যানেল), চালনা-রায়মঙ্গল, চাঁদপুর-মোহনপুর-মাওয়া-চরজানাজাত-দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া-আরিচা, চাঁদপুর-ইশানবালা-চরপ্রকাশ-আবুপুর-নন্দীবাজার-টেংরামারী-শিকারপুর ব্রিজের উজান পর্যন্ত, চরপ্রকাশ-মৌলভীরহাট-হিজলা-বামনীরচর-বাগরদা-ভাসানচর-বাগাদিয়া-বরিশাল, ষাটনল-দাউদকান্দি (মেঘনা-গোমতী রোড ব্রিজ পর্যন্ত), বরিশাল-বগা-দুর্গাপাশা-পটুয়াখালী-গলাচিপা-পায়রা বন্দর-বালিয়াতলী, ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা এবং সেন্টমার্টিন-টেকনাফ ইত্যাদি।

দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথের মধ্যে ঢাকা (সদরঘাট)-বুড়িগঙ্গা চীন সেতু-১ পর্যন্ত, চাঁদপুর-ইচলী, ঘাসিয়াখালী-বাগেরহাট, কালিকাপুর-মাদারীপুর-রামচর, বাহাদুরবাদ-বালাসি, চালনা (দাকোপ)-পাইকগাছা-আশাশুনি-প্রতাপনগর-(ট্রানজিট রুট), শেরপুর রোড ব্রিজ)-ফেঞ্চুগঞ্জ, খুলনা (অবলকান্তি)-বড়দিয়া-মানিকদাহ-কালিকাপুর, কোবাদাক-টেপাখালী ও হডডা-বানিয়াখালী-মদিনাবাদ-নীলডুমুর ইত্যাদি। তৃতীয় শ্রেণির নৌপথগুলোর মধ্যে বাঘাবাড়ী-বদলগাছি, ইচলী-রায়পুর, নরসিংদী-কটিয়াদি, বুড়িগঙ্গা ২য় সেতু-মিরপুর রোড ব্রিজ, সৈয়দপুর-শ্রীনগর, মারকুলি-ধিরাই, বাঘাবাড়ি-উল্লাপাড়া, সুরেশ্বর-কার্তিকপুর-ভেদরগঞ্জ-ডামুড্যা এবং গাগলাজুর-মোহনগঞ্জ (কংশ নদী)।

এ ছাড়া মোহনগঞ্জ-ঠাকুরাকোনা, চামড়াঘাট- নেত্রকোনা, বড়দিয়া-কালাচাঁদপুর, আলাইপুর-(খুলনা)-বাগেরহাট এবং মনুমুখ থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত নৌপথকে চতুর্থ শ্রেণির হিসেবে গণ্য হবে।

উল্লেখ্য, যেসব জলপথের নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং সেসব জলপথে সারা বছর বা বর্ষা মৌসুমে নৌযান চলাচল করে, ওই সকল জলপথের ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা ৩ বিধি অনুযায়ী, ছাড়পত্র নিতে হবে ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা সংস্থাকে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নদী,কালভার্ট,নৌচলাচল,বিআইডব্লিউটিএ,জলপথ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close