হাসান শান্তনু
নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর পাঁয়তারা!
এবারও চলছে নিম্নমানের কাগজে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর পাঁয়তারা। এ কাজে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি পেপার মিলস এবং মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট। এনসিটিবির কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী একটি চক্রও এর সঙ্গে জড়িত। তারা এনসিটিবির নির্ধারিত নীতিমালার তোয়াক্কা করছে না। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে এবার পাঠ্যবই ছেপে এসব চক্র বড় অঙ্কের টাকা লুটপাটের চেষ্টা চলছে বলে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
তথ্যমতে, ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানও পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য নিম্ন মানের কাগজ কিনে গোডাউনে জমা রেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এসব কাগজ দিয়ে বই ছাপানো শুরু করবে। এনসিটিবির কড়া নজরদারি না থাকায় নিম্ন মানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্রটি। যেসব প্রকাশক ইতোমধ্যে ছাপানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি এনসিটিবির নীতিমালা অনুসরণ করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চার রঙের পাঠ্যবই ৮০ গ্রাম সাদা কাগজে ছাপার যেসব শর্ত ছিল, তা তারা মানছে না। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, ৮০ গ্রাম কাগজে বই ছাপার কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কাগজের মান সর্বোচ্চ ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম। ফলে বইয়ের ছাপা অস্পষ্ট হচ্ছে। ঠিকমতো বাঁধাই করাও সম্ভব হচ্ছে না। ছাপাখানায় বই বাঁধাই করতে গেলেই কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ছবি থেকে কালি উঠছে। ছবির ব্যক্তিদের চেহারা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা যায় না।
জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে পাঠ্যবই ছাপানোর অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠছে। তবে এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এনসিটিবি। ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্ন মানের কাগজ ব্যবহার করে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ আছে কার্যাদেশপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় চক্রের সদস্যরা অনিয়মে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন বলেও মনে করেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা মূল্যেও পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এনসিটিবির পান্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয় টিআইবির প্রতিবেদনে। এ কাজে জড়িত জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা জনগণের অর্থ অবৈধভাবে লুটে নিচ্ছেন। এ অপকর্মে চেয়ারম্যান থেকে পিয়ন পর্যন্ত জড়িত। সম্মানীর নামে এ বছরের পাঠ্যবইয়ের কাজ থেকে তারা মোট ৫১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ১৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থা।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘নিম্নমানের কাগজের ব্যাপারে এবার আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। যেসব বই নিম্ন মানের কাগজে ছাপানো হয়েছে, সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। ইন্সপেকশন টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাঠ্যবই ছাপানোর ক্ষেত্রে যেন নিম্ন মানের কাগজ না দিতে পারে, তা দেখভাল করার জন্য। ইন্সপেকশন টিম এ ধরনের গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা যায়, এনসিটিবি প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তিন স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম, এর আলোকে পাঠ্যবই তৈরি ও তা মুদ্রণের কাজটি করে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম ও পা-ুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে ৯টি ধাপের ৮টিতেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। পাঠ্যবই মুদ্রণে ১১টি ধাপ আছে। এগুলোর মধ্যে ৯টিতেই অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটে থাকে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ইন্সপেকশন টিমকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে। আল নূর পেপার মিলস, গাজীপুর পেপার মিলস, মক্কা পেপার মিলস, পূর্বাচল পেপার মিলস, হাক্কানী পেপার মিলস, মোস্তফা এবং ইকো পেপার মিলস নিম্ন মানের কাগজ বাজারে সরবরাহ করছে। এসব পেপার মিলস বইয়ের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে বাজার দরের চেয়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা কম মূল্যে কাগজ সরবরাহ করার প্রস্তাব দিচ্ছে। এতে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব লুফে নিচ্ছে। পরে এসব কাগজ দিয়ে বইও ছাপানো হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাগজ খুবই নিম্ন মানের। এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত নষ্ট কাগজ রিসাইক্লিং করে ফের কাগজ উৎপাদন করে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে কয়েকটি পেপার মিলস এনসিটিবির কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছে।
টিআইবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঠ্যবই ছাপানোর অনিয়মের সঙ্গে এনসিটিবির কর্মকর্তারাও জড়িত। এসব কর্মকর্তারা পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বানের আগেই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাক্কলিত দর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে দরপত্র দাখিল করে। এসব কর্মকর্তার সঙ্গে দরপত্রদাতাদের আঁতাত রয়েছে। যে কারণে টেন্ডারসম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য প্রকাশ হয়ে যায়।
প্রতিবেদনে দুর্নীতির আরো বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলা হয়, পাঠ্যবইয়ের প্রকাশনা প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিতে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের একাংশ জড়িত। কোনো কোনো কর্মকর্তার নিজস্ব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আছে। বেনামে দরপত্রে অংশ নেয় ও কাজ পেয়ে থাকে। টেকনিক্যাল কমিটিতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে কার্যাদেশের জন্য চাপ দেওয়ার ঘটনা আছে। কাজ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব মুদ্রণযন্ত্র, বাঁধাই, লেমিনেটিং ব্যবস্থা, কাটিংযন্ত্র ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী থাকে না। এক কথায় দরপত্রে উল্লিখিত শর্তপূরণ করে না।
টিআইবির মতে, মুদ্রণকাজ দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শর্তগুলো পূরণ করে কি না তা দেখার ব্যবস্থা আছে। এ কাজে পরিদর্শনকারী এনসিটিবি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সম্মানী হিসেবে অর্থ নেন। তারপরও উল্লিখিত ঘাটতি থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়ে যাচ্ছে। যে কারণে প্রাপ্ত কাজের ২০ শতাংশ সাব-কন্ট্রাক্ট করার সুযোগ থাকলেও শতভাগ কাজ সাব-কন্ট্রাক্টের অভিযোগ আছে। শুধু মুদ্রণ নয়, বাঁধাই, লেমিনেটিং ও কাটিংও সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়ার অভিযোগ আছে।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন মানের হওয়ায় এবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাজেয়াপ্ত করে এনসিটিবি। প্রাথমিক পর্যায়ের বই ছাপায় নিম্ন মানের কাগজ ব্যবহার করায় বলাকা প্রিন্টার্সের প্রায় ২০০ টন, লেটার অ্যান্ড কালারের ২০০ টন, লেখন আর্ট প্রেসের ১০০ টন, এস আর প্রিন্টার্সের ১১০ টন, প্রিয়াংকার ১০০ টন, জুপিটারে ও সীমান্তে দুটি প্রিন্টার্সের আলাদা প্রায় ২০০ টন, সাগরিকার প্রায় ২৯০ টন, পিএ প্রিন্টার্স ৫০ টন, পেপার প্রেসের ৫৯০ টনসহ প্রায় ১৫ হাজার টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট ছোট আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাতিল হয়েছে।
‘‘পিডিএসও/তাজ