মোহাম্মদ আবু নোমান

  ০৫ জুন, ২০১৮

অলআউটেই আমাদের বিশ্বাস

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা শতাধিক হলেও লক্ষ করার বিষয়, এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যতই অন্যায় ও অমানবিক হোক, এর পক্ষেও কিছু লোকের সমর্থন রয়েছে। বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় পাঠকের মন্তব্যে দেখা যায়, বন্দুকযুদ্ধের কৌশলকে সমর্থন ও বিরোধিতার মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি নয়। সমর্থনকারীদের মন্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে, এই নিষ্ঠুরতা অনেকের কাছেই প্রশংসিত ও পছন্দনীয়! এতেই বোঝা যায়, মাদক সমস্যা জনগোষ্ঠীকে কতটা ভোগাচ্ছিল! কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে যাবতীয় নেশাজাতীয় দ্রব্য বিশেষত, ইয়াবার রেভুলেশন ঘটেছে। যেভাবেই হোক, মাদক ব্যবসাকে ‘দফারফা’ করা, এটাই সর্বসাধারণ বিশ্বাস করতে চায়। দশকের পর দশক প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মাদকের নেশা ও ফাঁদে পড়তে দেখেও কিছু করা হয়নি। মাদকের জালে জড়িয়ে লাখ পরিবারকে নেশার অভিশাপে চূড়ান্ত রকম জর্জরিত করেছে।

চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদকাসক্তদের ধরতে পারলে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার দৃষ্টান্তও আমাদের দেশে রয়েছে। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে মানুষের ধৈর্যচ্যুতির কারণ—পুলিশের দুর্নীতি, তদন্ত ঝুলে যাওয়া, মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে না পারা। সাদা চোখে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ কর্মসূচিটি সাধারণ মানুষের কাছে ভালো বলেই মনে হবে। কারণ বাস্তবেই মাদক ও মাদকাসক্তির মারাত্মক প্রভাব অনেক অপরাধেরও ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। মাদকাশক্তরা চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, রাহাজানি ও ডাকাতির সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে। এক গবেষণায় এসেছে, যদি কোনো দেশে শুধু মাদক বন্ধ করা যায়, তবে সেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ অপরাধ কমে যেতে পারে। মাদকের সঙ্গে যে অপরাধের সম্পর্কএ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ কথাও ঠিক, ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘এনকাউন্টার’ আপাতদৃষ্টিতে জনগণের একাংশের কাছে প্রশংসিত হওয়া ও অপরাধ সাময়িকভাবে কমানো সম্ভব হলেও এর মূল কারণগুলো বের করে সেভাবে পদক্ষেপ না নিলে এ অপরাধ আবারও ফিরে আসবে। কিন্তু এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে, বড় প্রচার চালিয়ে অভিযান চালানোর কারণে মূল মাদক কারবারি ও পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তারা মাদকের বিরুদ্ধে ‘অলআউট’ যুদ্ধে নেমেছেন, নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। কিন্তু কথা হলোএতে কয়েকদিন অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। কিছুদিন চুপ থেকে সরকারের এ কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদে-আসলে তারা লাভ তুলে নেওয়ার জন্য আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। পরিশেষে মাদক সমস্যাও তিমিরেই রয়ে যাবে! কারণ, গত কয়েকদিনের ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের শিকারদের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, দেশের নামকরা বা চিহ্নিত বড় রাঘববোয়াল মাদক কারবারিরা সেখানে নেই। নিহত ও গ্রেফতার হয়েছে শুধু ছিঁচকে কিংবা একেবারে ক্ষুদ্র অপরাধীরা।

মূল মাদক কারবারিরা একেকজন দেশের একেকটা ভাইরাস। এরা যত থাকবে তত মাদক সেবনকারী যেমন বাড়বে, তেমনি মাদক কারবারিরাও বাড়বে। এ জন্য বিষবৃক্ষের ডালপালা ছেঁটে লাভ কী? কেননা তা আবারও গজাবে। ডাল-পালা, লতা-পাতা ও আগা ছেঁটে গোড়া রেখে দিয়ে, কিছু চুনোপুঁটি মেরে অভিযান দেখিয়ে কী হবে! এ জন্য চিহ্নিত ‘মাদকসম্রাট’ বা মাদক ব্যবসা জগতের রুই-কাতলাদের স্পর্শ না করে, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত না করে, খুচরা মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অভিযান চালিয়ে স্থায়ী সুফল আশা করা যায় না। এ ছাড়াও বিশ্বে যেসব রাষ্ট্রে দুর্নীতি কম, সেখানে মাদকের কারবারও কম। এ জন্য দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তের গোড়ায় হাত দিতে হবে। মানুষ এখন সচেতন, নাটক বোঝার ক্ষমতা রাখে! এটা যেন নির্বাচনের আগে দলীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়া রাজনৈতিক কৌশল না হয়। সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি ও নিষ্ক্রিয় করতে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে এমন বেআইনি অভিযান, এ যেন উদ্দেশ্যে না হয়।

মাদক নির্মূলে আসামি নির্ধারণ, অপরাধী সাব্যস্তকরণ, সাজা নির্ধারণ এবং কার্যকর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ নয়। তাদের কাজ অপরাধীকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো। বিচারবহির্ভূত হত্যা, তা যে কারণেই হোক, আসলে দুর্বল শাসনব্যবস্থারই পরিচায়ক। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে আর এ ধরনের পদক্ষেপের দরকার পড়ে কি? এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অনেক নিরাপরাধ লোকও ভুলবশত বা ক্ষমতাশালী কারো প্রতিহিংসার বলি হতে পারেন।

মাদক কারবারির যারা বড় খেলোয়াড়, তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা যথেষ্ট পরিমাণে পেয়ে থাকেন। মাদকের সমস্যা এক দিনের নয়, অতএব সমাধানও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবেএমন ভাবনার সুযোগ নেই। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে মাদক নির্মূল করতে চায়, তাহলে একটা সামগ্রিক এবং বহুমুখী পরিকল্পনা তৈরি করে, একটা শক্তিশালী মাদকবিরোধী টাস্কফোর্সের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদকবিরোধী অভিযান,বন্দুকযুদ্ধ,বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist