আহমেদ আববাস

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

লন্ডনি কইন্যা

ভবেরবাজার। জাগতিক অস্তিত্বসম্পন্ন জীবনযাপনের সঙ্গে মানানসই এক মনোরম নাম। আপাত ধারণায় মনে হয়, এই গ্রামের মানুষ অতি সুখে-শান্তিতে, প্রেম-প্রীতিতে বসবাস করছে। আসলে কি তাই? না, এটা পুরোপুরি বাস্তব নয়। এখানে নৈমিত্তিক ঘটছে অনেক বিস্ময়কর এবং ভয়ংকর ঘটনা।

আদিম লালসা ও ত্বরিত বিত্ত লিপ্সায় এক পুরুষ বহু বিবাহে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে এভাবে নারীদেরও নৈতিক স্খলন ঘটছে। সর্বান্তঃকরণে আস্থাশীলতার জন্য সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে অনেক দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা। অনেক পূর্ণাবয়ব সুশিক্ষিত যুবতিও অসম পরিণয়ের ইন্দ্রজালে আটকে ভরাডুবির শিকার হচ্ছে। আর এ ধরনের ঘটনা অত্র অঞ্চলে হামেশাই ঘটছে। উপলক্ষ একটাইÑ লন্ডনের হাতছানি।

ভবেরবাজার বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম। এই গ্রামের ছেলে রাসেল এক বিকেলে জগন্নাথপুরে অন্যদের সঙ্গে নিজের জন্য কনে দেখতে যায়। সে শিক্ষিত সুদর্শন যুবক। দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এখন ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত। হ্যান্ডসাম স্যালারি। সুতরাং কনেটিও প্রিয়দর্শন হতে বাধা নেই।

সায়মা মনোরমা। সর্বাঙ্গে কোথাও রিক্ততা নেই, আছে প্রাচুর্যতা। পাঁচ ফিটের ওপরে উচ্চতা, দোহারা গড়নে মানানসই ফিগার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বেগুনি ও হালকা নীলের জমিনে নীল ছোটপাড়ের কাতান শাড়িতে মোহনীয় লাগে সায়মাকে। সঙ্গে ম্যাচিং বেগুনি ব্লাউজের অভ্যর্থনা অভাবিতরূপে আবেদন সৃষ্টি করে। মনে হয়, গায়ের রং শুধু টকটকে ফর্সা হলেই যে সুন্দরী হবে, এমন নয়। যাকে ক্রমাগত দেখার জন্যে চোখ টানে, সেই সুন্দরী। সায়মা এমনিই একটি মেয়ে। অধিকন্তু ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স।

কনে দেখতে আগত বরপক্ষের লোকজনের পছন্দ হয়ে যায় সায়মাকে। এমনকি প্রমিজিং পাত্র রাসেলেরও। সেজন্যে নির্ধারিত কক্ষে অকুস্থলেই বর-কনের আলাপচারিতার আয়োজন করা হয়। কুড়ি মিনিট সরব উপস্থিতি শেষে উল্লসিত মনে বেরিয়ে আসে রাসেল।

‘শালা, মনে কয় ভাবে মরি ঝিরাই। এবভাব জমাইলা নাকি তা।’ রসিকতার ছলে বন্ধু রাজিব আঞ্চলিক ভাষাতেই বলতে থাকে।

‘যারে লইয়া হারা জীবন গর সংসার করতাম, তার লগে বোঝাপড়ার

দরকার আছেনি।’

‘বিয়া অইতে না অইতেই বোঝাপড়া। তুই ব্যাটা পাগল হই গেছোস।’ বলতে বলতেই সহগামী বয়োজ্যেষ্ঠ একজন নিকটবর্তী হওয়ায় প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে থেমে যায়।

যথারীতি বরকনে এবং উভয়ের সম্মিলিত আগ্রহে সম্বন্ধ ফলপ্রসূ করার সিদ্ধান্ত হয়। দুজনের কারোই ‘প্রি-ম্যারিটাল প্যাশন’ না থাকায় আপনা থেকেই তাদের দেহমন উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। রাসেলের প্রাক-পরিণয় অনুরাগ দানা বেঁধে ওঠে বাগদত্তার প্রতি। আর সার্বক্ষণিক আসন্ন প্রণয়লীলার কথা ভেবে সময় কাটতে থাকে সায়মার।

কর্মস্থলে ঢাকায় ফেরে রাসেল। শুরু হয় অপেক্ষার পালা, অপেক্ষার যন্ত্রণা, কবে আসবে সেই শুভক্ষণ। কবে সায়মা তার বাহুলগ্রা হবে। কবে সে সায়মার শরীরের ঘ্রাণে একাকার হয়ে যাবে।

মানুষের ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ নিলে পৃথিবীতে কারো কোনো ক্ষোভ থাকত না। ঈপ্সিত বস্তু নিয়েই হয়তো মানুষ সুখী থাকতে চাইতো। তবু ঘববফ ্ এৎববফ বলতে একটা কথা আছে। মানুষের প্রয়োজন সম্পন্ন হতে পারে, কিন্তু লোভ আগ্রাসী থাকে।

ঢাকা থেকে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে রাসেল জানতে পারে, সায়মার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। তার মনে হয়, বহু শ্রমে নির্মিত আলোকিত তাজমহলের ইটগুলো এক ঝাপটায় আচানক ধসে পড়েছে। মনের গহিনে যন্ত্রণার তোলপাড় শুরু হয়, হতাশায় ভেঙে পড়ে। এ সময়েই তার বাবার কাছ থেকে সেলফোনে বিষয়টি জেনে আরো নিশ্চিত হয়। বাবা জানায়, মেয়েপক্ষ কথা রাখেনি। লন্ডনি ছেলের সঙ্গে সায়মার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের বাড়ি দোয়ারিবাজার। বাড়িতে ভালো পাকা ঘরবাড়ি, স্থানীয় বাজারে দোকান এবং লন্ডনে হোটেল ব্যবসা আছে। বিয়ে করেই মেয়েকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।

দুবছর পার হয়ে গেছে। তবু রাসেলের কম্পিউটার স্পিকারে বেজে চলে ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি/আনন্দে বিষাদে মন উদাসী’, ‘কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে না/তারে মানা করে কে, আমার মন মানে না’, ‘হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি’ অবসরে এ ধরনের বরীন্দ্রসংগীত শুনেই এখন তার সময় কাটে।

এদিকে আবার কনের খোঁজে সুনামগঞ্জের দিরাই, ছাতক, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, তাহেরপুর প্রায় সর্বত্রই চষে বেড়ায় পাত্রপক্ষের লোকজন। এমনকি দক্ষিণের জেলা হবিগঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু যথাযথ পাত্রি মেলে না। কনে পছন্দ হলে ঘরবাড়ি, সামাজিক অবস্থান বাগড়া দেয়। কোথাও ঘরদোর সামঞ্জস্যপূর্ণ পেলেও পাত্রির দাঁত উঁচু, গায়ের রং কালচে এবং উচ্চতায় খর্বাকার মনে হয়। আরো রয়েছে পাত্রের খুঁতখুঁতে ভাব।

একবার পছন্দনীয় কনে হাতছাড়া হয়েছে তো, কী হয়েছে? কনের কি অভাব? ডিজিটাল যুগে ওসব কেউ ভাবে নাকি? তুমি তো বাবা মহাভারতের দুষ্মন্ত নও যে, শকুন্তলা তোমার জন্যে বসে থাকবে! আবার শরৎবাবুর দেবদাসও নও, অন্তিম মুহূর্তে পার্বতী ছুটে আসবে। তুমি এ যুগে বড়জোর মানিকবাবুর ‘ভয়ংকর’ গল্পের প্রসাদ হতে পারো, যে ভূষণের স্ত্রী আশাকে নিরাশ করেনি।

তবু অপ্রকাশ্য চাপা অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে রাসেল। বিষয়টি কারো সঙ্গে সে শেয়ারও করে না। মানুষের মানবিক দায়বদ্ধতা নিয়ে মাঝে মাঝে

ভেবে হতাশ হয়।

অনির্ধারিত এবং আকস্মিকভাবে লন্ডনে চার সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের জন্যে তাদের ওষুধ কোম্পানি তাকে নির্বাচিত করে। কখনো কোনোভাবেই সে দেশের বাইরে পা রাখেনি। কিন্তু লন্ডনে তার কিছু আত্মীয় রয়েছে। সেখানে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই ভেবে লন্ডন যেতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

ঘটনাটি বাংলা সিনেমার মতো মনে হলেও কাকতালীয়ভাবে ব্রিকলেনের এক সুপার স্টোরে সায়মার সঙ্গে রাসেলের দেখা হয়। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ও বিষাদে মাথাটা ঝিম ধরে যায়। সায়মার বিবর্ণ, প্রাণহীন, নিস্তেজ, স্বতোদহন চেহারা দেখে একটু ভাবিয়ে তোলে তাকেÑ এ জগতে কী না সম্ভব! এই যেমন সায়মার সঙ্গে আচানক সাক্ষাৎ এবং তার নিষ্প্রাণ মুখাবয়ব।

‘এরে সায়মা, তুমি ভালা আছনি।’ বুকের গহিন থেকে রাসেলের মুখ ফসকে অতি কষ্টে বেরিয়ে আসে কুশল বাক্যটি।

‘দেখিয়া বুঝনাননি’ সায়মাও ক্ষোভের সঙ্গে জানান দেয়। এবং বলতে থাকে, ‘আমি হাছা আমার বাপমার লাগি শরম পাইছি। হাছা আমার কোনতা

করার আছিল না।’

‘ইকটা তোমার শরীর দেখিয়া বুঝতাম পারছি। আমি তোমার থাকিয়া এব বিয়া করতাম পারছি নায়।’

‘আমার কথা ভাবিও নায়, তুমি বিয়া করিলাও।’

এভাবে কুশল বিনিময়, স্মৃতি রোমন্থন, আলাপচারিতা এবং অতীতবিধুরতায় ফিরে যায় দুজন। তারা সে মুহূর্তে পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউন ব্রিকলেনে অবস্থান করছিল। একজন বাস করতো হোয়াইট চ্যাপেলে আরেকজনের সাময়িক আবাসন বেকন স্ট্রিটে।

দীর্ঘ সময় সুপার স্টোরে আলাপের পর পরবর্তী সাক্ষাতের জন্যে দিনক্ষণ এবং স্থান নির্বাচন শেষে দুজন প্রস্থান করে। দুজন নিজ নিজ আবাসে ফিরেই শুরু হয় একে অপরের প্রতি মানসিক প্রতিক্রিয়া। দুজন উদগ্র হয়ে ওঠে অভিসারের জন্যে। হয়ে ওঠে একজন অপরজনের জন্যে পাগলপারা।

সায়মার হাজব্যান্ড অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় অল্প বয়সেই পাড়ি জমায় লন্ডনে। এখানে সে একজন হোটেল ওয়ার্কার, সারা দিনের কাজ সেরে গভীর রাতে মদ খেয়ে বাসায় ফেরে। আর বউকে সর্বদা পর্দায় রাখতে খড়গহস্ত থাকে। নামাজ পড়তে চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু নিজে তার ধার ধারে না। সায়মা নিজকে স্বাবলম্বী, সংসারে সচ্ছলতা এবং শিক্ষাটাকে কাজে লাগাবার জন্যে চাকরিতে আগ্রহী হলে স্বামীর অনুমতি পায় সংযত এবং পর্দানশীলভাবে কর্মস্থলে যাতায়াতের। সেই থেকে সায়মা ব্রিকলেনের একটি ইনফ্যান্ট স্কুলে শিক্ষিকা।

তারা পূর্বনির্ধারিত ব্রিকলেনের বিখ্যাত এন্টারটেইনমেন্ট পার্কে অভিসারে মিলিত হয়। স্কুলের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাটাতে থাকে। নির্ধারিত বিরতি দিয়ে তারা সেখানে যেতে থাকে। এভাবে একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠ এবং ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায় সাত দিনের গোপন অভিসার শুধু আলাপচারিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অষ্টম দিন বিকেলের অভিসারে পার্কের বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায় তারা। অন্যদের মতো শারীরিক উদ্দামে মেতে ওঠে। এন্টারটেইনমেন্ট এমন একটি পার্ক, যেখানে কারো সঙ্গে সঙ্গী বা সঙ্গিনী থাকলে সংলগ্ন না হয়ে চুপচাপ নিষ্ক্রিয় থাকা দুরুহ ব্যাপার। অষ্টম দিনের মতো তারা তিনবার একই স্থানে একই সময়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তারপর রাসেলের লন্ডনে প্রশিক্ষণ ভ্রমণে অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

লন্ডন থেকে দেশে ফেরে রাসেল। বাড়ি এলে সবাই বিয়ের জন্যে তাকে চাপ দিতে থাকে। সে সবাইকে বোঝায়, বিয়ে নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না। ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে আর কিছুদিন কাজ করে এরপর জানাব।

নমাস যাবত রাসেল ঢাকায়। তবু সুনামগঞ্জ ফেরার সময় হয়নি। লন্ডনে যাবার আগে মনটা একটু দোদুল্যমান ছিল, বিয়ে এখন করবো কী করবো না। সে লঘুচিত্ততা আর চাপল্য এখন আর নেই। তার মনের ভেতর অভিপ্রায় এবং অভিন্নতা ফিরে এসেছে। তাই বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এখন অনেকটাই স্থির। সায়মার আগ্রহের শেষ পর্যন্ত দেখতে আগ্রহী সে। সায়মাকে সে কথা দিয়ে এসেছে। কথা না রাখার জন্যে সায়মার অভিভাবকদের প্রতি তার ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছিল। মানুষ কীভাবে কথা দিয়ে কথা না রাখে! রাসেল কি পারবে? তার অঙ্গীকৃত কথা রাখতে। সমাজের সকল বাধা উপেক্ষা করে সায়মা কি ফিরে আসতে পারবে? দুজনের স্মৃৃতিবিধুরতায় সর্বক্ষণ সমুজ্জ্বল সেই পার্কে উদ্দামতায় ভরা দিনগুলোর কথা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close