ফকির ইলিয়াস

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মেধাবৃত্তিক সাহিত্য নির্মাণের বিনিদ্র অধ্যবসায়

কবি কাজী রোজী যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাননি, তা আমার জানাই ছিল না। জগতে অনেকের অনেক কিছুই জানা থাকে না। থাকার দরকারইবা কী!

কত মানুষের নামের ভক্ত আমরা। কিন্তু এক জীবনে তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় না। হওয়ার দরকারও নেই। আমরা তাকে দূরে থেকে জেনে নিই। পড়ি। বুঝি। তার নির্মাণের সঙ্গে মিশে যাই।

২০১৯ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন কবি কাজী রোজী। তিনি ষাটের দশকের কবি। তার জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৪৯। রাজনীতি সচেতন কবি তিনি। ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত

আসনের এমপিও।

তার কবিতা আমাদের সমাজ বাস্তবতার চিত্র এঁকেছে বিভিন্নভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘ঝড়ের বৃত্ত থেকে সবাই আমরা বেরিয়ে আসতে চাই।/যে ঝড় দেখা যায় সময়ে তা থেমে যায়/ক্ষয়-ক্ষতির ধ্বংসাবশেষ আগলে ধরে/আবার মানুষ বাঁচতে চায়/উজ্জীবিত করতে চায়/সৃষ্টি করতে চায় নুন ইতিহাস।/মানুষ তা পারেও।/কিন্তু যে ঝড় দেখা যায় না.../তীব্র ক্ষরণে দাউ দাউ দহনে/লন্ডভন্ড ছারখার/সবটাই অনাচার অবিচার/সে ঝড়ের সমাচার কী!/‘আইলা’ দেখে মানুষ বলেÑ ‘দ্যাশের কুনহানে/বাঁচন নাই।’/ঝড়ের কত রকম ভেদ আছে।’ [ঝড়]

কাজী রোজী আমাদের অগ্রসরমান কবিদের একজন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সঙ্গে কাজ করেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সম্পাদকীয়মন্ডলীর সদস্যের দায়িত্ব পালনÑ এসব নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন তিনি।

ভাবতে অবাক লাগে, এই কবির বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেতে এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন? অথচ আমরা দেখেছি। অনেক অযোগ্য কবিই এই ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’টি পেয়েছেন। মতান্তরে তারা ছিনিয়ে নিয়েছেন!

এ বছর এই একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন চারজন। গবেষক-কলামিস্ট আফসান চৌধুরী এ পুরস্কার পাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের জন্য। কবিতার জন্য কবি কাজী রোজী, কথাসাহিত্যে মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল এবং প্রবন্ধ ও গবেষণায় একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবার

পুরস্কার পাচ্ছেন।

যে বিষয়টি না বললেই নয়, তা হলোÑ কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনি, নাটক, বিজ্ঞান/প্রযুক্তি/পরিবেশ, শিশুসাহিত্যÑ এ ১০টি শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার কথা থাকলেও এবার মাত্র চারটি শাখায় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এর কারণ কী? বাংলাদেশে কি সমৃদ্ধ স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনি লেখা হচ্ছে না? নাটক লিখছেন না নাট্যকাররা? এই সতেরো কোটি মানুষের দেশে কি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে না? এ দেশে কি মেধাবী শিশুসাহিত্যিক নেই? বাংলা সাহিত্যেও ভালো অনুবাদকর্ম হচ্ছে না? তা হলে এ শাখাগুলোতে পুরস্কার না দেওয়ার কারণ কী?

আমি অনুবাদ বিষয়ে এ নিবন্ধে কিছু কথা বলতে চাই। অনেকেই আজ বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের কথা বলেন। তা করতে হলে অনুবাদ করতে হবে শক্ত হাতে। এর জন্য উদ্যোগী হতে হবে। উদাহরণ দিই। একটি লিটল ম্যাগাজিনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি একজন প্রখ্যাত মার্কিন কবির তিনটি কবিতা অনুবাদ/রূপান্তর করেছি সম্প্রতি। এই কবিতাগুলো ভাবান্তর করতে গিয়ে আমার বড় মেয়ে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে মাস্টার্স প্রস্তুতি পর্বের ছাত্রী নাহিয়ান ইলিয়াসের সাহায্য নিয়েছি। একটা বিষয় প্রত্যক্ষ করলাম, তার আর আমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বেশ ভিন্ন। অনুবাদ এভাবেই ভিন্ন হাতে, ভিন্ন মাত্রা পায়। ভিন্ন

ভাবনা খুলে দেয়।

কিছুদিন আগে, কবি কামাল চৌধুরীকে নিয়ে আমরা নিউইয়র্কে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেখানে আমি অনুবাদের বিষয়টি বলেছি। জানতে চেয়েছি, বাংলা একাডেমির অনুবাদ সেলে কোনো বাজেট থাকে কি না। সাজেস্ট করেছি, অনুবাদ এভাবে হতে পারে; যেমনÑ ঢাকায় একদল পেইড অনুবাদক একটি ভালো উপন্যাস/কবিতার বই প্রাথমিকভাবে অনুবাদ করলেন। তারা সেটা আমেরিকায় পাঠালেন। আমেরিকায় একটি সমন্বয়ক টিম থাকবে। তারা আন্তর্জাতিক মানের কয়েকজন অনুবাদককে রেডি করে রাখবেন। সমন্বয়কারীরা প্রাথমিক অনুবাদ মার্কিন অনুবাদকদের হাতে তুলে দেবেন। এরপর ঢাকার মূল অনুবাদক, সমন্বয়কারী টিম ও মার্কিন অনুবাদকরা মিলে ফাইনাল করবেন। তারপর বইটি লন্ডন-নিউইয়র্ক-প্যারিস থেকে একযোগে বের হবে। কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু আমি জানি, আমরা চাইলেই তা পারব। আমি পারব, আমার দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু বাজেট কে দেবে? বাংলা একাডেমি দেবে? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেবে? টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। অনুবাদকের প্রতি ঘণ্টা সম্মানী নিউইয়র্কে ১৫০ থেকে ৩৫০ ডলার। এসব কথা আমি আমাদের সম্মানিত বন্ধু কবি কামাল চৌধুরীকে বলেছি। তিনি বলেছেন, ঢাকায় গিয়ে

কথা বলবেন।

এসব কাজ আমাদের এগোয় না। আমরা চাইলেও এগোতে পারি না। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী যান। কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেন হয় না? কেন আমাদের সাহিত্য বিশ্বের বাজারে পরিশুদ্ধ হাতে এগোয় না? এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের মেধাবী প্রজন্মকে খুঁঁজতে হবে।

বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বদলেছে। ‘সাহিত্যের অর্থনীতি’ বলে একটি বিষয় এখন আলোচনায়। অর্থনীতি শাসন করছে অনেক কিছুই। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে অনুবাদ খাতে বড় বাজেট রাখতে হবে। নিজেদের মূল্যায়ন, নিজেদের করতে শিখতে হবে।

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। এই মাসটি বাঙালির জাতীয় জীবনের সূতিকাগার। এই মাসেই ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছিল জাতি। তাও আবার রক্তের বিনিময়ে। চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে প্রতিহত করেছিল বাঙালিরা। কাজটি সহজ ছিল না। তার পরও রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালিরা।

সেই বাংলা ভাষার ব্যাপৃতি এখন জগৎব্যাপি। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন কোটি বাঙালি। তারা লিখছেন এই ভাষায়। তারা গাইছেন এই ভাষায়। তারা তাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা করছেন এই সুরে, স্বরে ও সাধনায়।

ফেব্রুয়ারির একটি বড় আয়োজন হচ্ছে ঢাকায় একুশের বইমেলা। মাসব্যাপী এই মেলার আদলে কলকাতায়ও দুই সপ্তাহের বইমেলার আয়োজন হয় ফেব্রুয়ারি মাসেই। বইমেলার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে আজ দেশ-দেশান্তরে।

হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেইÑ বইমেলা কিছু হুজুগে লেখক তৈরি করছে। এটা মারাত্মক দিক। ভালো কিছু বই দিচ্ছেÑ এটা ভালো দিক। ভালো বইগুলোর লেখকরা তা সময় নিয়ে লেখেন। তা পড়লেই বোঝা যায়। ফেসবুককেন্দ্রিক কবি হয়ে, শত শত ‘লাইক’ নিয়ে যারা বই বের করেন, ওই লাইক যারা দিয়েছিল, তারাই কিন্তু বইটি কেনে না। সাহিত্যে প্রভাবের বিষয়টি একটি স্থায়ী শক্তি। এক মাস সময়, সেই প্রভাব ফেলতে পারে না। যেকোনো সময় বের হওয়া একটি বই-ই কিন্তু একটি ভাষার সাহিত্যে মাইলফলক হয়ে যেতে পারে।

নির্মাণের অধ্যবসায়টি বড় কঠিন কাজ। এই কাজটি করতে না পারলে সাহিত্য মাঠে আবর্জনা ছড়িয়ে লাভ কী! নিজের খায়েশে বই বের করে ঘরের কোণ ভরে রাখা যায়। কিন্তু পাঠক তা হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখে না। কেন দেখে না, এর কারণটি খুঁঁজতে হবে আমাদের সবাইকে। শানিত চিন্তকের কাজই হলো পঠন-পাঠন। ভাবতে অবাক লাগে, আজকের পাঠককে বই পড়ার কথা বললেই তারা বলে উঠেন, ‘বইটি কি অনলাইনে আছে?’

আমি খুব নিশ্চিত, আমাদের মহান লেখকদের যেসব বই অনলাইনে রয়েছেÑ সেগুলোও তারা পড়েননি। পড়েন না। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি এখন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close