আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২০ এপ্রিল, ২০১৯

একজন ভোটারের জন্য দুর্গম পথ পেরিয়ে বুথ

ভোটার মাত্র একজন! আর তার ভোট নিতে ৪৮৩ কিলোমিটার পার্বত্য দুর্গম পথ উজিয়ে বুথ তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন। টানা চার দিনের চড়াই-উতরাই যাত্রা শেষে সেই অস্থায়ী বুথে সোকেলা তাওয়াংয়ের ভোট নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভোটকর্মী থেকে নিরাপত্তারক্ষীরা। বললেন, ‘সোকেলার ভোটদান নিশ্চিত করতে পেরে দুঃসাহসিক অভিযানের ক্লান্তি ভুলেছি।’

ভারতে ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে সোকেলা একজন। পার্বত্য অরুণাচলের দুর্গম এলাকা মালোগাঁওর একটি ছোট্ট জনপদে বাস তার। ওই জনপদে সাকুল্যে পাঁচটি পরিবারের বসবাস। তাদের মধ্যে ভোটদানের অধিকার পেয়েছেন একমাত্র সোকেলা। পেয়েছেন কমিশন প্রদত্ত সচিত্র পরিচয়পত্রও। ওই পাঁচ পরিবারের অনেকেই বলেছিলেন, সোকেলার জন্য এতটা দুর্গম পথ ভেঙে আসার প্রয়োজন নেই ভোটকর্মীদের। বরং অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক জায়গায় বুথ তৈরি হোক। সোকেলাকে নিয়ে সেখানেই ভোট দেওয়াবেন তারা।

গ্রামবাসীদের ওই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিলেন মালোগাঁওয়ে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা অফিসার গাম্মার বাম। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, জীবন বাজি রেখেই ভোটারের উঠানেই তৈরি হবে বুথ। সেই মতো দলবল নিয়ে প্রস্তুতিও শুরু করে দেন তিনি। কারণ কমিশনের নিয়মই হলো দুই কিলোমিটারের বেশি পথ পেরিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না ভোটাররা।

গত ১১ এপ্রিল ছিল প্রথম পর্যায়ের ভোট। গোটা দেশের গণতন্ত্রের উৎসবে সোকেলাকে শামিল করাতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ছিলেন বাম। কমিশনের নির্ঘণ্ট মেনে ঠিক সাতটায় মালোগাঁওয়ে বুথ খুলে বসেছিলেন তিনি। বুথ বলতে পার্বত্য ঢালে নড়বড়ে টিনের ছাউনি। চারদিকে ঝোপঝাড়। সেই ছাউনির এক কোণে ইভিএম রাখা। প্লাইউড দিয়ে যতœ করে ঘেরা সেটি। নির্বাচনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ছাউনিতে ধীর গতিতে ঢুকলেন সোকেলা। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বামকে দেখালেন নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র। তারপর বামের নির্দেশমতো ইভিএমে বোতাম টিপে একগাল হাসি হাসলেন সোকেলা। ভোট দিতে পেরে তিনি খুশি। চাইলেন ভোটের বিনিময়ে মালোগাঁওয়ের উন্নয়ন। আর সোকেলার ভোট নিতে পেরে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীদের মুখে তখন বিজয়ীর হাসি। ঘড়ির কাঁটা মেনে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকল সেই বুথ। এভাবেও ভারতে এখনো ভোট হয়।

দেশের শেষ জনগণনায় ঠাঁই পায় মালোগাঁওয়ের ওই পাঁচ পরিবার বিশিষ্ট জনপদ। সেখান থেকে অনতি দূরেই চীন। খাড়া পাহাড় ভেঙে ভেঙে সীমান্ত ঘেঁষা ওই জনপদে যাওয়াই দস্তুর। একটাই পথ। এবং একলা চলাই পথের দাবি। একসঙ্গে দুজনে যাওয়াই মানে মৃত্যুর হাতছানি।

কেমন ছিল সেই অভিযান? অরুণাচলের পার্বত্য শহর ৩ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হাওয়াই থেকে যাত্রা শুরু করেন ভোটকর্মীরা। নেতৃত্বে অরুণাচলের সরকারি ইঞ্জিনিয়ার বাম। সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা। তাদের হাতে ইভিএমসহ ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যবহৃত ৬৭টি সামগ্রী। দুর্গম পথে সেই অভিযানের কথা বলতে গিয়ে বারবার শিউরে উঠছিলেন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী বাম। বলছিলেন, যাত্রা শুরুর দিন থেকেই ট্রেকিং করতে করতে পাহাড়ি পথ ভেঙেছি। কখনো সেই পথে ডিঙোতে হয়েছে খরস্রোতা নদী। ঝুলন্ত রুটব্রিজ। একটু অন্যমনস্ক হলেই কয়েক হাজার ফুট গভীর খাদে। নিচের দিকে তাকালেই হিম হয়ে যায় গোটা শরীর। মালোগাঁয়ের হাতছানি পেয়েও স্বস্তি ছিল না বামেদের। চার দিনের মাথায় আট ঘণ্টার পথ পেরিয়ে প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মালোগাঁওয়ের। তবুও সেটা ছিল দীর্ঘ চড়াই পথ! আর তখনই সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। ভোটকর্মী রূপক তামাং বলছিলেন, ‘চারিদিকে জঙ্গল। ক্রমেই ঘন হচ্ছে অন্ধকার। খরস্রোতা নদীর ভয়ংকর গর্জন। বড্ড নার্ভাস লাগছিল আমাদের। কিন্তু থেমে থাকার কোনো উপায় ছিল না।

তাই অন্ধকার ভেদ করেই ট্রেকিং করছিলেন বামেরা। ভোর পাঁচটার মধ্যেই যে সম্পূর্ণ তৈরি করে ফেলতে সোকেলার জন্য বুথ!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close