ডা. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান খান

  ২৪ আগস্ট, ২০১৭

জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা তথ্য

অনিয়ন্ত্রিত বা ঘন ঘন সন্তান জন্মদান মা এবং শিশু উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গর্ভধারণ মায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে, এমনকি মায়ের জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আমাদের দেশে গর্ভজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। সন্তান যত বেশি হয় এ সম্ভাবনাও তত বাড়তে থাকে। ঘন ঘন সন্তান জন্মদানের ফলে মায়ের মারাত্মক রক্তস্বল্পতা, গর্ভপাত, গর্ভকালীন রক্তপাত, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। স্মরণ রাখা দরকার যে, মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সঙ্গে নবজাতকের স্বাস্থ্যের বিষয়টিও সম্পর্কিত। এ কারণে গর্ভস্থ শিশু যথাযথভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না এবং স্বাভাবিকের চেয়ে (২.৫ কেজি) কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ ধরনের শিশু মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হতে পারে, কানে কম শুনতে পারে, অপুষ্টি, পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারে এবং চোখের দৃষ্টিতে ত্রুটি থাকতে পারে। কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশু পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি, পরিপূর্ণ বিকাশ এবং দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। সাধারণত এদের স্কুল পারফরম্যান্সও খারাপ হয়ে থাকে।

মানবদেহের রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে হিমোগ্লোবিন। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে তাকে রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া বলে। আয়রন বা লৌহ রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সঠিক রাখতে সহায়তা করে। আমাদের দেশের অনেক মহিলাই আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঘন ঘন সন্তান জন্মদান, মহিলাদের প্রতি সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ, খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে প্রজননকাল পর্যন্ত প্রতিমাসে একবার করে ঋতুবতী হওয়ার ফলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ, কৃমির সংক্রমণ প্রভৃতি গর্ভকালীন মহিলাদের শরীরে আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায়। গর্ভকালে মা এবং গর্ভস্থ শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে দুই বা তিনগুণ বেশি আয়রন বা লৌহের প্রয়োজন হয়।

ঘন ঘন সন্তান জন্মদানকারী মহিলার আগে থেকেই রক্তস্বল্পতা থাকে। রক্তস্বল্পতাজনিত কারণে গর্ভবতী মহিলা প্রায়ই ক্লান্তি এবং দুর্বলতা বোধ করেন। অবসন্নতা, মাথা ঝিমঝিম করা, বুক ধড়ফড় করা, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, শ্বাসকষ্ট হওয়া কিংবা হাত-পায়ে পানি আসা মারাত্মক রক্তস্বল্পতার লক্ষণ। এ সময় ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হাত-পায়ের তালু, জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি এবং চোখের নিচের পাতার ভেতরের দিকে এ ফ্যাকাশে ভাব পরিলক্ষিত হয়। গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা না করালে গর্ভবতী মহিলার হার্ট ফেইলিউর বা গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। এছাড়া রক্তস্বল্পতা গর্ভবতী মহিলার ইনফেকশন এবং গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্যও দায়ী। এ কারণে গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

এ জটিলতার কথা মাথায় রেখে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত একজন মহিলা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত গর্ভধারণ করা উচিত নয়। গর্ভকালীন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবার এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে রঙিন শাকসবজি (যেমন-কচুশাক, ডাঁটাশাক, লালশাক) ও ফলমূল, দুধ, মাছ, গোশত, কলিজা, ডিম প্রভৃতি লৌহসমৃদ্ধ খাবার খেলে রক্তস্বল্পতা দূর হয়। এ ছাড়া ভিটামিন ‘সি’সমৃদ্ধ খাবার যেমন- আমলকী, লেবু, জাম্বুরা, আমড়া, আনারস, পেয়ারা ইত্যাদিও খেতে হবে। এতে শরীরে আয়রন বা লৌহের শোষণ ভালো হয়। দুই. গর্ভধারণের মাঝে কয়েক বছর (দুই থেকে তিন বছর) সময় নিলেও রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্য পরস্পর সম্পর্কিত। জন্মনিয়ন্ত্রণ মায়ের অসুস্থতা, অপুষ্টি, গর্ভজনিত জটিলতা তথা মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধ করে। সর্বোপরি মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখে। নিয়ন্ত্রিত গর্ভাধারণ গর্ভস্থ শিশুর অস্বাভাবিকতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনে এবং নবজাতকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। বস্তুত জন্মনিয়ন্ত্রণ মানে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ পরিহার করা, মায়ের বয়স অনুসারে প্রথম ও শেষ সন্তান উপযুক্ত সময়ে (২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে) গ্রহণ করা, সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখা এবং একটি সন্তান জন্মদানের দুই থেকে তিন বছর পর পরবর্তী সন্তান গ্রহণ করা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একজন মহিলা গর্ভবতী হলে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে না এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমে যায়। বলা হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ হচ্ছে একটি পরিবারের শিশুকে রক্ষার অন্যতম উপায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শিশু সঠিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ, পুষ্টি এবং দক্ষতাও বেড়ে যায়। সন্তান সংখ্যা কম হলে পরিবারের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটে।

জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist