অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

দলীয় প্রতীকবিহীন ভোটই সংঘাত প্রশমন করবে

সম্প্রতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করেছেন। অনেকের মতে ছয়টি চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে তিনি সরকার গঠন করেছেন, যার একটি হলো বিদেশিদের চাপ। অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- আর্থিক দোদুল্যমানতা ও অর্থনীতির নিম্নগামিতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থ পাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, মাদকের ব্যাপক বিস্তার ও দ্রব্যমূল্যে লাগামহীনতা রোধ। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসবকে অর্থনীতি ও কূটনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বলেছেন। অবশ্য বিগত কদিনে প্রারম্ভে অনুচ্চারিত হয়নি এমনি একটি সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ গভীর সংকট ও তাৎপর্য নিয়ে উপনীত হয়েছে, সমস্যাটির নাম অভ্যন্তরীণ কোন্দল; আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রদের সংঘাত। কোন্দলের শুরুটা হয়তো মনোনয়নের দিন থেকেই, যা তখন বাক্যবাণে সীমাবদ্ধ ছিল। স্বজন বা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা পরাজয়ের গ্লানি গুছতে কিংবা প্রতিপক্ষকে একহাত নিতে বাগবিতণ্ডা, হাতাহাতি, মারামারির মধ্যে এমন সব বিষয়াদি সামনে নিয়ে এসেছিল, যা সচরাচর বিরুদ্ধবাদীরাই তুলে ধরে। আপাতত এসবে থলের বিড়াল বের হয়ে পড়ছে বলে কেউ কেউ মনে করলেও এসব যে কানার হাতে কুড়াল তুলে দেওয়ার শামিল, তা গণনা যথার্থ। এসবকে উপজীব্য করে দেশ ও বিদেশে প্রকাশ্যে বা ঘাপটি মারা বিশেষ শক্তিগুলো আওয়ামী লীগকে একহাত নেওয়ার উপকরণ হাতড়িয়ে নিচ্ছিল। তবে ঘরের শত্রু বিভীষণ হলে যা হয়, নৌকা প্রতীকে এবং অন্যান্য প্রতীকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র অংশীজনই তাই করছে, যার ফলে সমূহ ক্ষতি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের ঐক্য, বন্ধুত্ব, সংহতি বা দৃঢ়তা পূর্ণার্জন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বন্ধু শত্রু হলে যা হয় তা হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা ১৯৭২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের ভাণ্ডারে জমা আছে। সেকালে আওয়ামী লীগকে দুর্বল, অবাঞ্ছিত এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র যারা প্রস্তুত করেছিলেন, তারা ছিল আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লড়াকু সৈনিক ও যোদ্ধা। এবারের সংঘাতকারীদের ভেতর ত্যাগী-যোগী, নিবেদিত ও সত্যিকারের বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, জননেত্রী শেখ হাসিনার বিহ্বল ভক্ত, অনুরক্ত নেই, তা বলব না। কিন্তু তাই বলে তাদের মধ্যে কিছু বিভীষণ যে নেই তা হলফ করে বলা যায় না। নির্বাচনের পূর্বে ও নির্বাচনকালে তারা অনেকটা সংযত থাকলেও বা তাদের নিজস্ব বা গোষ্ঠী স্বার্থে হয় নেত্রীর ভয়ে বা নির্বাচন কমিশনের ভয়ে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খড়গের ভয়ে সংঘাতটাকে বাক্যবাণসহ সামান্য পরিমাণ হত-আহতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। অর্থাৎ তখন ধামাচাপা থাকলেও আওয়ামী লীগ বনাম স্বতন্ত্র সংঘাত অনুস্থিত কিংবা অবোধ্য ছিল না। নির্বাচনের আগের স্বল্পসংখ্যক হানাহানি বা আহত-নিহতের ঘটনা নিরীহ ভোটারদের মনে ভয় ধরিয়ে ছিল। সে কারণে প্রকৃত আওয়ামীভক্তরাও ভোট বর্জন করে বিএনপির লক্ষ্যকে বরং এগিয়ে দিয়েছে। তারা জানত তাদের অনুপস্থিতিতে জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, তাতে আওয়ামী লীগেরই জয় হবে। পরের ধাপে ক্রমেই প্রতিপক্ষকে তারা রাজপথের সহযোদ্ধা বা নিবেদিত সহকর্মী অপেক্ষা এক নম্বরের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করেছেন, কেউ নির্বাচিত হয়েই ভবিষ্যতে পথের কাঁটা সম্পূর্ণ নির্মূল করতে কিংবা কেউ পরাজিত হয়ে টাকার কামড় সামলাতে কিংবা দাম্ভিকতাকে অবদমন করতে না পেরে বিবৃতির মাধ্যমে আত্মতৃপ্তির পথ ধরেছেন। বিরোধী দল গতানুগতিক যেসব অপবাদ সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের পরাস্ত অংশটি ও পরাস্ত স্বতন্ত্ররা একই অপবাদ দিয়েছেন। তারা যদি নির্বাচনে অদৃশ্য শক্তির কারচুপি দেখেন কিংবা সাম্প্রদায়িক উসকানি ও কালো টাকার খেলা দেখেন, কিংবা ভোটডাকাতি বা প্রশাসনিক অনিয়ম দেখেন তাহলে বিরোধীদের মূল দায়িত্বটা তারাই কাঁধে নিলেন বই কী? তাই হয়তো বিরোধী দল এসব না বলে আরো মৌলিক প্রশ্ন তুলছে। বিএনপির মুখে উচ্চারিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী দল। তার সঙ্গে যদি ১৪-দলীয় মিত্র, জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগীরা বা নির্বাচনে সারথি তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ইত্যকার মিত্রবেশীরা একই সুরে কথা বলে তাহলে বিএনপি যেসব ইস্যুকে পূর্বে অনুমান হিসেবে নিয়েছিল, এখন তারা তথ্য-উপাত্তের বদৌলতে সেগুলোকে অনুসিদ্ধান্ত নয় বরং উপসংহার বলে চালিয়ে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ- নিস্তেজ হয়ে পড়া আন্দোলনে বিএনপি ও সতীর্থরা এসব ব্যবহারে গতি আনছে।

আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ নির্বাচন পূর্বের অবস্থাটা চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এই সহিংসতায় আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই খুন করছে আওয়ামী বা অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। বাড়িঘর, দোকানপাট হামলার শিকার হচ্ছে। দলীয় কার্যালয় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কবলে পড়ছে। কিছু সতর্কতা বা সাবধানতা উচ্চারিত হলেও থামছে না আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বা নৌকা সমর্থকদের লড়াই। এর ফলে গত বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে নিহত ১৫ জন, আহত ২ হাজার ২০০, গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১০০-এর বেশি। শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, হামলা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়ি ধ্বংসযজ্ঞ এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা অবিরত চলছে। ইসিতে হাজারের বেশি মামলা হয়েছে- শপথ গ্রহণের পর এ জাতীয় মামলা গড়াচ্ছে আইন-আদালতে। এসব অপকর্ম থামাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। পূর্বে যেখানে কয়েকজন সিপাই দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা থামানো গেছে, এখন সেখানে উচ্চপদস্থ অফিসারসমেত প্লাটুন অধিক পুলিশ ন্যস্ত করা হচ্ছে। তারপর মারামারি, খোনাখুনি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটতরাজ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ থামছে না। ভোট-পরবর্তী হুমকি ও প্রতিহিংসার কারণে হাজার হাজার মানুষ এলাকা ছাড়া। বিরোধীরা এবার আরো জোরে হাততালি দিচ্ছে। ভোট-পরবর্তী সহিংসতায় ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। আত্মকলহ ও গৃহবিবাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো লোক কমিয়ে দিচ্ছে। হয়তো এসবই নির্বাচন কমিশনকে দ্বিধান্বিত করছে। খেদের সহিত তারা বলছেন, নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এই নির্বাচনটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। তিনি তিনটি চাপের মধ্যে দুটির কথা উল্লেখ করলেও তৃতীয়টি অনুল্লেখ রেখেছেন। অনুমান করা যায়, কমিশন নির্বাচন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কূটচালের কাছে কিছুটা হলেও হার মেনেছে। ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে সংকটে পড়েছেন। ভোটার উপস্থিতি আরো বেশি হতো; যদি না নিজেদের দ্বন্দ্ব বা বাক্যবাণ বর্ষণ আরো সংযত হতো। নিজেদের মধ্যে আগেই সংঘাত ছিল বলেই সংখ্যালঘু ও নিজ দলীয়দের অনেকে ভোটকেন্দ্রে আসেনি। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানই শ্রেয়কর ভেবেছে। কিন্তু তারা হয়তো ভাবেনি যে তাদের অনুপস্থিতিটা নির্বাচন দেশ-বিদেশে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে। কেননা ভোটে অংশগ্রহণের মাপক হিসেবে শুধু অংশীজন দলগুলোই নয়, কত ভোটার ভোট দিল তার ওপরও নির্ভর করে।

নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট না হয়ে তা ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ বা ৭১ দশমিক ৮ শতাংশও হতে পারত। আওয়ামী লীগ নেত্রীর ৭০ শতাংশ জনপ্রিয়তার সঙ্গে মিত্র বা সহযোগীদের ভোট যোগ হওয়ার সুযোগ ছিল। এমনকি বিএনপি বা জামায়াতভুক্ত আত্মীয়স্বজনদের ভোটও ভোটের আকৃতিটা স্ফীত করত। চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭০ শতাংশের ভোট পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন পূর্ব বাকযুদ্ধ বা হুমকি-ধমকি বা কিছু আহত-নিহতের ঘটনা সারা দেশেই ভোটারদের কম নিরুৎসাহিত করেনি।

মারামারি, হানাহানি, খোনাখুনি ছাড়াও এসব সংঘাতে লিপ্তরা এখনো জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে এমন সব তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে, যা বিরোধী দলের আরো অপপ্রচারের মোক্ষম সুযোগ করে দিচ্ছে। এসব তথ্য বিদেশে পাচার হচ্ছে, নতুন সরকারের প্রতি নেতিবাচক তির্যক মন্তব্যের প্রবাহকে বাড়িয়ে দিচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতে সরকারকে ঘায়েল করার অস্ত্র শানে সাহায্য করবে। টিআইবির কাছে তথ্য দাতাদের পরিচিতি নিলে দেখা যাবে তার বিশালাংশ ঘরের শত্রু বিভীষণ। এমতাবস্থায় সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনুরোধ, উপদেশ বা মৃদু চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এসব কারণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় মনে হয় পার হয়ে যাচ্ছে। এই যে সংঘাত ও ১৯৭৫ সালের সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও এমন দুর্ঘটনা ও দুঃসময় দেখার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ও তার শাহাদাতের পর আমরা উপলব্ধি করেছিলাম বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করা বা হটিয়ে দেওয়ার কোনো শক্তি নেই। আমার ভয় হচ্ছে এমন দুঃসময় কি আবার আসছে? আর অনৈক্য, বিভেদ কি আওয়ামী লীগকে চরম বিশৃঙ্খল, নিবীর্য ও শক্তিহীন সংগঠনে রূপান্তরিত করবে, যার ফলে বিরোধীরা ঝোঁপ বুঝে কোপটা মেরে বসবে?

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না করে সবাইকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দিয়ে সংঘাত প্রশমিত করা হয়তো যাবে। সংঘাতকারীদের পুনরায় মার্কিনি খড়গের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে কাজ কিছুটা হতেও পারে। মোহগ্রস্ততারা হয়তো ভুলে যাচ্ছে যে তাদেরও কারো কারো বিদেশে বাড়ি আছে, সম্পদ আছে, সন্তানাদিরা পড়াশোনা বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত আছে। উপজেলা নির্বাচনে তো বটেই এমনকি স্থানীয় সরকারের অন্য নির্বাচনগুলোতে সবাইকে স্বতন্ত্র হয়ে ভোট করার সুযোগ দিলে নির্বাচনকালীন বা নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস কম হবে। এই প্রতীকবিহীন নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে প্রয়োজনে নির্বাচনী বিধিতে সংশোধনী আনা যেতে পারে। তবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রতীক দিতেই হবে। তখন সংঘাত, সংঘর্ষ, ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী বা দলের বদনামে লিপ্তদের কোনো অবস্থায় মনোনয়ন দেওয়া সংগত হবে না।

আমরা অনেকেই অন্ধ, চোখ থাকতে অন্ধ। সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আমরা দেশ, জাতি ও দলের যে অপূরণীয় ক্ষতি করছি, তা অনেকের বোধের বাইরে। দলের আদর্শের প্রতি অনুগতদের দলে ফিরিয়ে আনাই বাঞ্ছনীয়। স্বতন্ত্র এমপি আওয়ামী লীগাররা স্বতন্ত্র হিসেবে অবস্থান করলে তারা ভবিষ্যতে এমন সব সংকট সৃষ্টি করবে যে দেশের বিরোধীদের সংখ্যা স্ফীত করতে পারবে কিংবা বিদেশিদের মহাসংকট সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। ক্রমেই আর একটি ১৯৭৫ সৃষ্টির পথ তৈরি করতে পারে। তাই ভাবনা আমাদেরও পেয়ে বসেছে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close