প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থান গাথা
ঋণের চিন্তায় দিশাহারা শুভ শীলের পরিবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ শুভ শীলের পরিবারে এখন শোকের মাতম। একদিকে সন্তান হারানোর বেদনা, অন্যদিকে ঋণের বোঝা। কোনদিক সামলাবে পরিবার? সন্তানের চিকিৎসাব্যয় মেটাতে সাড়ে ৪ লাখ টাকা সুদে ঋণ নিয়েছেন হতদরিদ্র বিকাশ শীল। তিনি এখন এই ঋণ এখন কীভাবে শোধ করবেন?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন শুভ শীল (২৫)। আহত অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই তিনি মারা যান।
শহীদ শুভ শীল সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন জিরানী বাজার এলাকার বাসিন্দা বিকাশ শীল (৫৫) ও সাধনা শীল (৪৫) দম্পতির পুত্র। দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভ ছোট। শুভ শীল সাভারের কেসি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। বড় ভাই সোহাগ শীল (২৭) স্থানীয় অ্যাপারেলস গার্মেন্টে চাকরি করেন। বিকাশ শীল পেশায় নরসুন্দর।
শুভ শীলের মা সাধনা শীল বাসসকে জানান, শুভ শীল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। অনেক কাছ থেকে গুলি করায় গুলিটি তার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আহত অবস্থায় শুভ শীল ৫টা ৫৫ মিনিটে মায়ের মোবাইল ফোনে ফোন করলে তার বড় ভাই সোহাগ শীল ফোন রিসিভ করে। গুলিবিদ্ধ শুভ শীল ফোনে ভাইকে বলে, ‘ভাই ওরা আমাকে গুলি করেছে, আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি। আমি তো শেষ। আমি মনে হয় আর বাঁচব না।’ গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে প্রথমে শুভ শীলের মামা বাসুদেব বিশ্বাস ও পরে তার মা ও ভাই এবং রাত ১০টার দিকে বাবা হাসপাতালে আসেন।
শুভ শীলের মা সাধনা শীল তার ছেলের মৃত্যুর জন্য চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাই বাসুদেব সন্ধ্যা ৭টায় হাসপাতালে পৌঁছে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের দ্রুত চিকিৎসা শুরুর তাগিদ দিলেও তারা কালক্ষেপণ করতে থাকে। আমরা পৌনে ৮টায় হাসপাতালে পৌঁছে দেখি শুভর চিকিৎসা তখনো শুরু হয়নি। এ সময় চিকিৎসার তাগিদ দিলে চিকিৎসকরা জানান প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই অনেক রক্ত লাগবে। তখন আমি ও আমার বড় ছেলের রক্তের গ্রুপ একই জানালেও চিকিৎসকরা এই রক্ত দেওয়া যাবে না বলে আরো সময় নষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে হাসপাতালে নেওয়া হলেও রাত ১০টা পর্যন্ত শুভ শীলের কোনো চিকিৎসা শুরু হয়নি।’ সাধনা আরো জানান, এ সময় শুভ শীল তার মায়ের কাছে পানি চান। কিন্তু চিকিৎসকদের নিষেধ থাকায় তা দিতে পারেননি। শুভ শীল এ সময় মায়ের কাছে মাফ চান। একপর্যায়ে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয় শুভ শীলের পরিবারের সদস্যদের। পরে বিকাশ শীল ও তার পরিবারের সদস্যদের পীড়াপীড়িতে রাত ১০টার পর চিকিৎসা শুরু হয়। এ সময় চিকিৎসকরা জানান, তার পেট দিয়ে গুলি ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এতে তার নাড়ি ছিঁড়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। টানা চার দিন সেখানেই চলে শুভ শীলের চিকিৎসা। পুত্রের চিকিৎসাব্যয় মেটাতে স্থানীয়দের কাছ থেকে সুদে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ নেয় তার পরিবার। যার মধ্যে ওষুধের বিলই পরিশোধ করতে হয় ১ লাখ টকার ওপরে। আর বাকি টাকা ব্যয় হয় হাসপাতালের খরচ মেটাতে। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৩ তারিখ ভোরবেলা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শুভ শীল। সাধনা শীল পরিবারের এমন অবস্থায় প্রশাসনের সহযোগিতা ও পুত্রহত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
শহীদ শুভ শীলের মামা বাসুদেব বিশ্বাস বাসসকে বলেন, পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই আশুলিয়ার জিরানীবাজার এলাকা থেকে আমাদের বাড়ি ধামরাই উপজেলার চৌটাইল গ্রামে বেড়াতে আসে শুভ শীল। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনে অনেকে হতাহত হওয়ায় আমি ওকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতাম না। ২০ জুলাই দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমি বাড়ির বাইরে যাই। এ সময় শুভকে আমি বাইরে বের হতে নিষেধ করি। কিন্তু আমি বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বেলা ৩টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডের দিকে যায়। এরপর দুপুর সাড়ে ৫টার দিকে ও গুলিবিদ্ধ হন।
আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের বরাত দিয়ে বাসুদেব বিশ্বাস জানান, গোলাগুলি দেখে শুভ একটি দোকানের ভেতরে গিয়ে পালালেও খুব কাছে গিয়ে ওকে গুলি করা হয়। সে সময় গুলিটি ওর পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওকে সবাই মিলে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে সাড়ে ৬টার দিকে। সেখানে দীর্ঘক্ষণ ওকে ফেলে রাখা হয়। অনেক তাগিদ দেওয়া হলে রাত ১০টার পর ওর চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা।
তিনি ভাগনের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়ে সমাজের বিত্তবানসহ সংশ্লিষ্টদের ওর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
শহীদ শুভ শীলের বড় ভাই সোহাগ শীল মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, ভাই হারানোর বেদনা বলে বোঝানোর নয়। অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল শুভ। পরিবারের কথা অনেক চিন্তা করত। আমাদের বাবা পেশায় নাপিত। অসচ্ছলতার সংসারে পরিবারের হাল ধরতে শুভও কাজ নেয় পোশাক কারখানায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফোনে ওর সঙ্গে আমারই কথা হয়। তখন ও আমাকে বলে, ‘ভাই আমাকে ওরা গুলি করেছে, আমি মনে হয় আর বাঁচাব না। আমাকে তোরা মাফ করে দিস।’ তখন আমি ওকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বললে ও বলে আমি হাসপাতালে যাওয়ার অবস্থায় নেই, আমার অবস্থা খুব খারাপ। এরপর ফোন রেখে দেয়। পরে স্থানীয়রা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ও মারা যায়। ভাইয়ের অভাব পূরণ হওয়ার নয় উল্লেখ করে সোহাগ শীল আরো বলেন, ছোট ভাইটির চিকিৎসা করাতে গিয়ে আজ আমাদের পথে বসতে হচ্ছে। কয়েক লাখ টাকা দেনা হয়েছে। আমাদের এখন কীভাবে চলবে তাও বুঝতে পারছি না।
শহীদ শুভ শীলের বাবা বিকাশ শীল মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের ঝিনাইদহ সদর থানাধীন মনোরিয়া গ্রামে। সাভারের আশুলিয়ায় এসেছি ২০ বছরেরও বেশি সময়। আমার দুটি ছেলেসন্তান। শুভ শীল ছিল ছোট। ওর গুলিবিদ্ধের খবরে ওর মা-ভাই আগে চলে গেলেও দেরিতে খবর পাওয়ায় আমি ১০টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শুভকে পড়ে থাকতে দেখি। তখন ও আমার কাছে মাফ চেয়ে বলে বাবা আমি মনে হয় আর বাঁচাব না, আমাকে তোমরা মাফ করে দিয়ো। এ কথা শুনে আমি নিস্তব্ধ হয়ে যাই। চিকিৎসকদের বলি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে। তখন রাত ১০টার পর শুভর চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা। সেখানে ডাক্তাররা একের পর এক ওষুধ আনতে বলেন। অভাব-অনটনের সংসার আমাদের। জমাকড়ি বলতে কিছুই নেই আমাদের। কিন্তু ছেলের চিকিৎসার কথা ভেবে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিই। এভাবে নিতে নিতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ছেলের ওষুধ আর চিকিৎসার খরচ দিই। তারপরও ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বিধাতার কাছে চলে গেছে সে।
বিকাশ শীল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার আজ প্রায় তিন মাস হতে চলল, এখনো পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাইনি। শুনেছি অনেকেই অনেক ধরনের সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের সাহায্যে এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, এমনিতেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আছি। ধীরে ধীরে ঋণের দায়ও বাড়ছে। এমন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
"