মো. শাহ আলম, খুলনা

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

খুলনায় নবায়ন ছাড়াই চলছে ১৫৭ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলছে অসংখ্য অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অনেকে অনলাইনে আবেদন করেই ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালা করছেন। অনেকে লাইসেন্স পেলেও বছরের পর বছর নবায়ন না করেই ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালিয়ে যাচ্ছেন। এরকম খুলনা মহানগর ও উপজেলায় লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই চলছে ১৫৭টি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর অনুমোদনবিহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৪টি।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ এবং সঠিক তদারিক না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে নজরদারি না থাকায় এই অরাজকতা চলছে। যদিও সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর কয়েকটি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, খুলনা শহরে ২৭০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। এর মধ্যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নবায়ন রয়েছে ৯৮ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের। এছাড়া নবায়ন হয়নি এমন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ১৫৭টি। এর মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১০২টি এবং ক্লিনিক আছে ৫৫টি। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের এক বছরের, কারো দুই বছরের কারোবা তিন বছরের আবার কেউ চার বছরেও কোনো নবায়ন করেননি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, নগরীতে আবেদন না করেই পরিচালিত হচ্ছে এমন অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে রয়েছে খুলনা শিশু হাসপাতাল (ক্লিনিক), খুলনা শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার (ডায়াগনস্টিক), খুলনা ডায়াবেটিক হাসপাতাল, ডায়াবেটিক সমিতি, খুলনা (ডায়াগনস্টিক), সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক-১ (ডায়াগনস্টিক), সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক-২ (ডায়াগনস্টিক), জাপান মেডিকেল সেন্টার (খুলনা শাখা-১) এবং নিউ পথ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র।

এর বাইরে নগরীতে শুধু অনলাইনে আবেদনের ওপরই বছরের পর বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে ১৪টির। এর মধ্যে রয়েছে বয়রা সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বয়ো ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, নূরজাহান ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, কালিয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কালিয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পাল্প ডেন্টাল সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাই মেডিকেল ল্যাব ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, জেনারেল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার, বেস্ট কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার-১, বেস্ট কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার-২, রহিমা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার এবং শাবাব ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। এসব বৈধ-অবৈধ অনেক হাসপাতালে প্রায়ই ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে জড়িত এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্লিনিকের জন্য প্রতি বছর নবায়ন করতে খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা এবং ভ্যাট দিতে হয় ৭৫০০ টাকা। সব মিলে নবায়নে খরচ পড়ে ৫৭৫০০ টাকা। এছাড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নবায়ন করতে খরচ পড়ে ২৫ হাজার টাকা। যার ভ্যাট হয় ৩৭৫০ টাকা। এর বাইরে ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশের ছাড়পত্র, নারকোটিক, কর সার্টিফিকেট, ভ্যাট সার্টিফিকেট এবং ফায়ার সার্ভিসের জন্য নবায়ন করা জন্য আলাদা টাকা খরচ করতে হয়। সেই হিসাবে ওই দুইটি নবায়নের জন্য খরচ ধরলে এক বছরে ১৫৭ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মোট সরকার রাজস্ব আয় হবে ৫৭ লাখ ২৩ হাজার ২০০ টাকা।

খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মো. সবিজুর রহমান বলেন, জেলায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়ায় এ পর্যন্ত ৫-৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারেরর বিরুদ্ধে অভিযানের পাশাপাশি যাদের লাইসেন্স আছে কিন্তু শর্ত অনুযায়ী পরিচালনা করছেন না তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, জেলায় অনিবন্ধিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে একটি টিম মাঠে কাজ করছে।

খুলনা জেলা প্রশাসকের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, খুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অনুমোদনহীন ল্যাব পরিচালনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপারেশন পরিচালনার নগরীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও লাইসেন্সের কাগজপত্র ত্রুটি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৈধ সনদ, নিয়মিত নবায়ন, নারকোটিক পারমিট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পরিবেশ ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) কাগজপত্র সত্যায়িত করে সংরক্ষণ করতে হবে, যা পরিদর্শনকালে নিরীক্ষা করতে হবে। বিশেষ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিটির শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নামণ্ডঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র লাগবে। চিকিৎসা সাহায্যকারীদের তালিকা, যন্ত্রপাতির তালিকা, বর্তমানে যেসব অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকা হাসপাতাল প্রধানের স্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই এসব শর্ত শতভাগ মানা হচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, খুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অনুমোদনবিহীন ল্যাব পরিচালনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপারেশন পরিচালনার জন্য দুই ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জরিমানা প্রদান করে র‌্যাব-৬। ১৭ জানুয়ারি নগরীর মোহাম্মাদনগর ও গল্লামারি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাদের জরিমানা করে র‌্যাব।

র‌্যাব-৬ জানায়, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অনুমোদনবিহীন ল্যাব পরিচালনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপারেশন পরিচালনা করায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনারের সহযোগিতায় নগরীর মোহাম্মাদনগর ও গল্লামারি এলাকায় ছফুরা ক্লিনিক ও মোহাম্মাদনগর হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। এ সময় ছফুরা ক্লিনিকের মালিক মো. জিয়াউর রহমানকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম করায় ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং মোহাম্মাদনগর হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মিসেস নুরুননাহারকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জরিমানার অর্থ তাৎক্ষণিক প্রদান করায় সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close