নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ জানুয়ারি, ২০২৪

মেট্রোরেল : সহজ যাতায়াত পরিবেশবান্ধব আবাসন

দুই ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীসহ রাজধানীর উত্তরায় মেট্রোরেল স্টেশনসংলগ্ন দিয়াবাড়ীতে থাকেন জাহিদ হাসান নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তার ভাষ্য, আমার আগের বাড়ির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বড় বাড়ির ভাড়া উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ১৫ হাজার টাকার আশপাশে। মেট্রোরেলে অফিসে আসা-যাওয়া করলে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৪-৫ হাজার টাকা লাগছে যাতায়াত খরচ। আগের খরচেই যদি ভালো বাড়ি আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে পারি, তবে তা হাতছাড়া করব কেন?

জাহিদ হাসান আগে থাকতেন ফার্মগেট এলাকায়। বাড়ি ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকার মতো। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু হওয়ার পরই মেট্রোরেল স্টেশনের আশপাশে বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। ভাড়া সাধ্যের নাগালে, পরিবেশটাও খোলামেলা। তাই সপরিবারে দিয়াবাড়ী এলাকায় স্থায়ী হন জাহিদ।

রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের আংশিক যাত্রা। তবে গত নভেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের স্টেশন খুলে দেওয়ার পরই জাহিদ হাসানের মতো আরো অনেকেই নিজেদের থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন নতুন করে। সাধারণ যানবাহনে জ্যামের ভোগান্তি পেরিয়ে যে পথটুকু পেরোতে আগে ২-৩ ঘণ্টা সময় লেগে যেত, বর্তমানে মেট্রোরেলে করে একই পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে ৩০-৪০ মিনিটে।

এতদিন যারা কাজের খাতিরে মতিঝিল-ফার্মগেটের মতো জনবহুল এলাকাগুলোয় থাকতেন বাধ্য হয়ে, তাদের সামনে হাজির হয়েছে নতুন রাস্তা। অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি এলাকা ছেড়ে সাজানো-গোছানো মনোরম পরিবেশে বাড়ি বদল করার পরিকল্পনা উঁকি দিচ্ছে অনেকের মনেই। উত্তরায় মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর আশপাশে নতুন করে গড়ে উঠছে অনেক আবাসিক এলাকা। স্থানীয়দের ধারণা, দিয়াবাড়ীর মতো এলাকাগুলো মফস্বল ভাব ছাড়িয়ে খুব শিগগির পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় রূপ নেবে।

রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় বাসা ঠিক করার সময় খেয়াল রাখতে হয় অনেক বিষয়। শুধু ভালো পরিবেশই নয়, যাতায়াত ব্যবস্থা, সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তার পাশাপাশি সবচেয়ে বড় চিন্তা হয় বাসা ভাড়াটা সাধ্যের ভেতর হবে কিনা। মেট্রোরেলের কারণে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা কমলেও বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বসবাসের এলাকা পরিবর্তনে ইচ্ছুক অধিকাংশ পরিবার।

তেমনই এক পরিবারের কর্তা জালাল আহমেদ। মতিঝিলে অফিস, পরিবার নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকেন অফিসের কাছাকাছিই। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর একবার ভেবেছিলেন উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের দিকে বাড়ি বদল করবেন। কয়েক মাস আগেও শুনেছিলেন ১৫-১৬ হাজার টাকার ভেতর বেশ ভালো বাড়ি পাওয়া যায় সেদিকে।

কিন্তু ইদানীং নাকি সেই এলাকায়ও বাড়ি ভাড়া বাড়ছে হুহু করে। জালালের ভাষ্য, উত্তরার পুরোনো সেক্টরগুলোয় আগে থেকেই বাড়ি ভাড়া বেশি ছিল। ১৮ নম্বর সেক্টর যেহেতু নতুন, আরেকটু দূরে তাই ভেবেছিলাম সেখানে ভাড়া কম থাকবে। কিন্তু সেখানে থাকা পরিচিতদের কাছে শুনেছি নতুন বছরে বেশিরভাগ বাড়ি ২-৩ হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। সার্ভিস চার্জ-টার্জসহ ভালো বাসাগুলো সব ২০ হাজার টাকার ওপর ভাড়া। তাই আপাতত বাসা বদলের চিন্তা বাদ দিয়েছি। গোছানো এলাকায় সাধ্যের মধ্যে বাড়ি ভাড়া পেলে ইচ্ছা ছিল সেখানে চলে যাওয়ার।

তবে সব দিক বিবেচনা করে ভালোভাবে খুঁজলে উত্তরায় মেট্রোরেল স্টেশনের আশপাশে কম ভাড়াতেও ভালো বাড়ি পাওয়া সম্ভব মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। রাজধানীর বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা সৈয়দ আল সাহাফ বলেন, আমার পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সামনের মাসে মতিঝিলের বাসা ছেড়ে উত্তরার বাসায় উঠছেন। একই ভাড়া কিন্তু বাসার সাইজ দ্বিগুণ। উত্তরায় নিজেদের বাড়িতেই পরিবারসহ বসবাস করেন মাহিমা রিতু। তিনি জানান, গত কয়েক মাসে তাদের বাড়ির ৮-৯টি ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে ফার্মগেট-মতিঝিল এলাকা থেকে। মেট্রোরেলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতির কারণেই তারা এলাকা বদল করেছেন বলে ভাবছেন রিতু।

ঢাকার আরেক বাসিন্দা মঈম ইসলামের মতে, যাতায়াত ব্যবস্থা যেহেতু ভালো তাই সামর্থ্য থাকলে ঘিঞ্জি এলাকায় না থেকে ভাড়া বেশি হলেও মানুষ পরিকল্পিত পরিবেশে থাকতে চাইবে। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরার নতুন আবাসিক এলাকাগুলোর পাশাপাশি রাজধানীর মিরপুরের দিকে বসবাসেও নাগরিকদের আগ্রহ বাড়বে। তবে মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশনের আশপাশে পল্লবী, বর্ধিত পল্লবীর মতো আবাসিক এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। মতিঝিল-ফার্মগেটের মতো এলাকা থেকে এ এলাকায় বাড়ি বদলের সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না স্থানীয়রা। উত্তরার নতুন এলাকাগুলোর তুলনায় মিরপুরের আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়াও তুলনামূলক বেশি।

নগর পরিকল্পনাবিদের ভাবনা : মেট্রোরেলের কল্যাণে রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায় পরিবর্তন নগরবাসীর বসবাসের এলাকা নির্বাচনের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরাও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদের ভাষ্যে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে সাধারণ মানুষজন যোগাযোগ ব্যবস্থার করিডোরে বসবাস করতে চায়। বাসস্থানের এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা বেশকিছু জিনিস বিবেচনা করে।

যার মধ্যে বাড়ি ভাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি অন্যতম। পাশাপাশি পরিকল্পিত অবকাঠামো, খোলা জায়গা, বাজারঘাটের সুবিধাও প্রাধান্য পায়। বাড়ি ভাড়ার কথা বিবেচনা করে আবাসিক এলাকা হিসেবে শহরের মাঝামাঝি এলাকার চেয়ে সাইডের এলাকাগুলো বেশি পছন্দ করে মানুষেরা। তার মতে, উত্তরা দিয়াবাড়ীর দিকে এলাকাগুলো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে দ্রুত গড়ে উঠছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সেখানে। তাই নগরবাসীও মনোরম, শান্ত পরিবেশের টানে এদিকটায় বসবাসে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close