তপন বাগচী

  ২৫ মে, ২০১৭

ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় সংবাদকর্মীর সচেতনতা

গণমাধ্যমে বাংলাভাষার অপপ্রয়োগ নিয়ে কমবেশি লেখালেখি হলেও আমরা একটি আদর্শ অবস্থান বেছে নিতে পারিনি। এ আমাদের জাতীয় দৈন্য। একসময় দৈনিক সংবাদে যশোর থেকে প্রবোধচন্দ্র সাহা এবং নাটোর থেকে এমএ সামাদ নামে দুই স্কুলশিক্ষক চিঠিপত্র লিখে বানান ভুল ও ভাষার অপপ্রয়োগ নির্দেশ করতেন। পরে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রণজিৎ বিশ্বাস ‘ব্যবহারিক বাংলায় ভ্রমকণ্টক’ নামে নিয়মিত কলামনিবন্ধে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার একক আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। কবি-সাংবাদিক অরুণাভ সরকার সংবাদপত্রে ভাষার অপপ্রয়োগ নিয়ে বেশকিছু নিবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর লেখা একটি গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে এবং আরেকটি গ্রন্থ বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তর্কাতীত না হলেও তাঁর বক্তব্য বাংলাভাষা ব্যবহারে সুচেতনা সৃষ্টির সহায়ক বলে আমার ধারণা। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ‘সংবাদপত্রে বাংলা ভাষা’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। এছাড়া ড. হায়াৎ মামুদ, ড. মাহবুবুল হক ও দিলীপ দেবনাথ রচিত ভাষা ও বানান বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য খুবই দরকারি।

পুরনো পত্রিকা ঘাটতে গিয়ে চ্যানেল আইয়ের একাদশ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র আমার চোখে পড়ে। স্বাভাবিক নিয়মে এ পৃষ্ঠাটি বেশ কয়েকটি পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে বিজ্ঞাপনী গুরুত্বে। ভাষারীতি পরীক্ষার নমুনা হিসেবে এই ক্রোড়পত্রের মূল রচনাটিকে আমি গ্রহণ করি মূলত তিনটি কারণে-

১. নিবন্ধের লেখক বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সম্পাদক ও প্রকাশক

২. নিবন্ধের বিষয় বাংলাদেশের গণমাধ্যম

৩. নিবন্ধটি বিশেষ উপলক্ষে ক্রোড়পত্র আকারে সযতœ প্রকাশিত

‘চ্যানেল আই আমাদেরকে আশান্বিত করে’ শিরোনামে আপাতদৃষ্টিতে ভুল দেখা না গেলেও এটি যে ব্যাকরণসিদ্ধ নয়, তাও জানা থাকা দরকার। ‘ইত’ প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দ বসে কর্মবাচ্যে। তাই আশান্বিত (আশা+অন্বয়+ইত) করে হতে পারে না, হতে পারে ‘আশান্বিত হই’। তাই শিরোনামটি হতে পারত, ‘চ্যানেল আই আমাদের আশা জাগায়’ অথবা ‘চ্যানেল আই দেখে আমরা আশান্বিত হই’।

প্রথম বাক্যে লেখা হয়েছে, ‘চ্যানেল আইয়ের ১১ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে ...’। হতে পারত একাদশ বর্ষে বা বছরে। ১১টি বছরে একসঙ্গে পা দিতে পারে না, দিতে পারে ১টি বছরে। সেই ১টি বছর হলো ১০ বছর পরের বছর অর্থাৎ একাদশ বছর। দ্বিতীয় বাক্যে লেখা হয়েছে, ‘... সৃজনশীল টিভি চ্যানেল দেখার সৌভাগ্যবান দর্শক’। একই বাক্যে ‘দেখার’ আর ‘দর্শক’ শব্দের প্রয়োগ শ্রুতিকটূ। হতে পারত ‘... সৃজনশীল টিভি চ্যানেলের সৌভাগ্যবান দর্শক’। লেখা হয়েছে, ‘... টিভি নিউজ সাংবাদিকতার আরেকটি নতুন দিক।’ সাংবাদিকতা শব্দের মধ্যেই তো ‘নিউজ’ বা ‘সংবাদ’ শব্দটি রয়েছে। তাই হতে পারত ‘... টিভি সাংবাদিকতার আরেকটি নতুন দিক’। লেখা হয়েছে, ‘... একদিকে রাজনীতিক অঙ্গনে যেমন জবাবদিহিতার

চর্চা শুরু হয়েছে...’। ‘রাজনীতিক’ বলতে ‘রাজনীতিবিদ’ অর্থাৎ ব্যক্তি বোঝায়। আর ‘জবাবদিহিতা’ নামের কোনো শব্দ বাংলাভাষায় নেই। তাই বাক্যটি হতে পারত, ‘... একদিকে রাজনৈতিক (বা রাজনীতির) অঙ্গনে যেমন জবাবদিহির চর্চা শুরু হয়েছে...’।

লেখা হয়েছে, ‘... আর এর পেছনে অবশ্যই চ্যানেল আইয়ের সব সাংবাদিক, শিল্পী, কর্মকুশলীসহ সকল স্টাফদের অপরিসীম পরিশ্রম ও নিষ্ঠা রয়েছে’। একই বাক্যে ‘সব’ ও ‘সকল’ ব্যবহারের উপযোগিতা আমাদের বোধগম্য নয়। তাছাড়া ‘সব’, ‘সাথে’ প্রভৃতি শব্দ কবিতা ও গানে বেশি মানায়। এগুলো ভাষাবিদের কাছে ‘ব্যাড প্রোজ’ বা ‘মন্দ গদ্য’ হিসেবে চিহ্নিত। এর পরিবর্তে ‘সকল’ কিংবা ‘সঙ্গ’ ব্যবহার করাই শ্রেয়। তারপরও কথা থেকে যায়। বাংলাভাষায় বহুবচনের দ্বিত্ব হয় না। তাই ‘সকল স্টাফদের’ চলে না। হতে পারত ‘সকল স্টাফের’।

লেখা হয়েছে, ‘টেলিভিশনকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে যে বিপুল অবদান রাখা যায় তার প্রমাণ শাইখ সিরাজ’। লেখকের বক্তব্য এখানে অস্পষ্ট। শাইখ সিরাজ-ই কি তার প্রমাণ? নাকি প্রমাণ তাঁর কর্মকা- বা অনুষ্ঠান? নাকি শাইখ সিরাজ তা প্রমাণ করেছেন? ‘টেলিভিশনকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে যে বিপুল অবদান রাখা যায়, শাইখ সিরাজ তা প্রমাণ করেছেন’-এ রকম বলা হলে কিছুটা হয়তো স্পষ্ট হতো।

লেখা হয়েছে, ‘... যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীব্যাপী দেশের গানবাজনা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।’ এখানে ‘পৃথিবীব্যাপী দেশের গানবাজনা’ শুনলে কি আরাম লাগে? দেশের গানবাজনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়ার কথা হয়তো লেখক বলতে চেয়েছেন। তাই শব্দের স্থান বদল করে লেখা যেত, ‘... যার মধ্য দিয়ে দেশের গানবাজনা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীব্যাপী মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।’ যথাস্থানে যথাশব্দের প্রয়োগ না হওয়ায় অর্থবিপত্তি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

লেখা হয়েছে, ‘... এবং সংবাদে আরও উন্নততর প্রয়াস গ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে টেলিভিশনের অবদানের এক নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে তুলবে’। ‘আরও উন্নততর প্রয়াস’ হতে পারে না। হতে পারে ‘উন্নত প্রয়াস’ অথবা ‘উন্নততর প্রয়াস’। আরও উন্নত মানেই তো উন্নততর। বাংলাভাষাকে আপন করে না নিতে পারলে এই ধরনের অপপ্রয়োগ ঘটতেই থাকবে বলে আমার আশঙ্কা।

এই নিবন্ধে আরও কিছু ভুল রয়েছে। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পথে আমরা আর এগোচ্ছি না। আবার বিশ্লেষণের জন্য কেবল একটি নিবন্ধও যথেষ্ট নয়। গোটা পত্রিকাকে নমুনা ধরলে, এ ধরনের ভুলের তালিকা আরও বাড়ানো যায়। দেশের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকের ছোট্ট একটি নিবন্ধে যদি এই ধরনের ভুলের সমাহার থাকে, তাহলে অন্য লেখকদের রচনায় কেমন ভুল থাকতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

গণমাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান পদক্ষেপ নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগও এই বিষয়ে পাঠদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারে। আমরা জানি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের উদ্যোগে পবিত্র সরকার ও রফিকুল ইসলামের সম্পাদনায় দুই খ-ে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’। এই সমন্বিত ব্যাকরণে ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের সীমারেখা নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা রয়েছে। তা মান্য করার দায়িত্ব নিতে হবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদেরই। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।

ভাষাচর্চায় এবং রক্ষায় সবচেয়ে সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে গণমাধ্যম, বিশেষত সংবাদপত্র। সংবাদকর্মীরা সচেতন হলে বাংলাভাষা রক্ষা পাবে অশুদ্ধতার হাত থেকে।

লেখক : কবি-গীতিকার-প্রাবন্ধিক। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist