মিজান রহমান

  ০৭ মার্চ, ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চিরঞ্জীব অনুপ্রেরণার মহাকাব্য

ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...।’ এরপর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম..., এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু ভাষণই নয় বরং এটি যেন একটি মহাকাব্য। এ ভাষণে একদিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র প্রোথিত, অন্যদিকে জাতির স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ও গ্রন্থিত। এ ভাষণ শুধু রাজনৈতিক দলিলই নয়, রণকৌশলের দিক দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার পরিচায়ক। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রাজনীতির কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর সৃষ্টি-বাঙালি জাতির চিরঞ্জীব অনুপ্রেরণার এক মহাকাব্য।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে এসব মন্তব্য করেছেন দেশের শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক-নাট্যব্যক্তিত্ব এবং ভাষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ভাষণে তথাকথিত পরিশীলিত বাচনভঙ্গির চেয়ে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের ভাষা থাকায় গোটা দেশের মানুষকে আপ্লুত এবং মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভাষণই ছিল না বরং এটি বাঙালি জাতির জন্য একটি শপথ ছিল। ওই দিন বাঙালিরা শপথ নেয় এবং ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’

বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক আরেফিন আরো বলেন, ৭ মার্চের ভাষণটি শুধু একটি ভাষণই নয় বরং এটি একটি মহাকাব্য। আর এজন্যই আন্তর্জাতিক নিউজউইকে পত্রিকা ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ইস্যুকৃত সংখ্যার কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি) হিসেবে অভিহিত করেছিল।

অনেকেই মনে করেন ৭ মার্চ এক অলৌকিক মুহূর্তে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এমন অসাধারণ ভাষা, ভঙ্গি ও আঙ্গিকগত স্বাতন্ত্র্যে বাঙ্গময়তার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল, যা মনে হয় যেন এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার স্পর্শে উচ্চকিত ভাষণ। যে ভাষণ মানুষকে তার মর্মমূল থেকে গভীরভাবে উদ্দীপ্ত এবং জাগ্রত করে তুলেছিল। এতে করে এই ভাষণের পরতে পরতে যুক্ত হয়ে থাকা দ্রোহের বাণী মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, এমনকি প্রয়োজনে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় উত্তীর্ণ করে তোলে। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতার বীজমন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের অশেষ প্রেরণা এবং বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে আধুনিক ইতিহাসের একটি অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং আন্দোলনের দলিল হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এতে ভাষাগত যে উৎকর্ষ আছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। তিনি বলেন, কলকাতা কেন্দ্রিক ভাষার বাক্য প্রকরণ রীতির বিপরীতে পদ্মাপাড়ের ভাষা ও বাক্য প্রকরণ রীতির উন্মেষ ঘটেছিল এই ভাষণের মধ্যে। এতে করে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হচ্ছে বাংলা ভাষা একটি সুনির্দিষ্ট দিকে বাঁক নেয়, যা পোশাকি ভাষার বিপরীতে ভাটি বাংলার মৃত্তিকা সংলগ্ন ভাষা। এ কারণে এটি শুধু রাজনৈতিক দলিল নয়, একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল এই ভাষণ।

তিনি বলেন, ভাটি বাংলার খরাস্রোতা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ধ্বনি এবং ভঙ্গি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছিল। যার কারণে সারা দেশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই ভাষণ শুনেছে যার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যুগ যুগ ধরে। সেদিনের ভাষণ পাঠ করলে বিভিন্নভাবেই স্বাধীনতার মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো ছিল একটি চূড়ান্ত লড়াইয়ের নির্দেশ।

ভাষণে সবকিছুকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপরই অকুতোভয় বাঙালি এবং সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ে। ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তি কত যে প্রচন্ড হতে পারে তা দখলদার বাহিনী তো বটেই বিশ্বের মানুষও দেখেছে অবাক বিস্ময়ে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ রণকৌশলের দিক দিয়ে অসাধারণত্ব, আবেগ আর স্বতঃস্ফূর্ততার পরিচায়ক। যে ভাষায় তিনি কথা বলতেন সেই ভাষায় তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। এ ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের গৌরব সম্মান আরেকবার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ,ঐতিহাসিক ৭ মার্চ,শেখ মুজিবুর রহমান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close