মো. সিরাজুল ইসলাম সোহাগ
মৃত্যুপথে দেশান্তর ঠেকানো জরুরি
অবৈধ পথে দেশান্তর একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ঘটনা। বাংলাদেশে এ হার দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। করোনাকালেও এর বিশেষ হেরফের হয়নি। গত কয়েকমাস যাবৎ ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রায় পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশী তরুণ স্বপ্নের ইউরোপে পৌঁছাবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনে যাচ্ছে বসনিয়ার জঙ্গলে।
হাড়কাঁপানো শীতের প্রকোপে ভয়ানক মানবেতর জীবন যাপন করছে পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ-প্রতিবেশে। এছাড়াও অনেকে মূত্যুকে উপেক্ষা করে আমেরিকার মরীচিকায় ঘুরপাক খাচ্ছেন বিভীষিকায় আমাজন জঙ্গলে। মানবপাচারের প্রকৃতি ও কার্যকারণ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এই জঘন্যতম অপরাধটি সংগঠিত করা কোন একক ব্যক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়। হাজারো মানুষের জীবনকে বিপদাপন্ন করার পেছনে জড়িয়ে আছে বিশাল এক চক্র। যে যে দেশে মানবপাচার হয় সেই দেশে দালালদের মধ্যে থাকে বিশাল এক যোগসূত্র ও সমন্বয়।
সাম্প্রতিক ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টাকারীদের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ! যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মতো দেশের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। নিসন্দেহে এই পরিসংখ্যান আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বড় কারণ।
বিগত কয়েকদশকের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক স্থিতিশীল ও ঊর্ধমুখী। তারপরও কেন তরুণরা ১৫ থেকে ৩৮ লাখ টাকায় ইউরোপ ও আমেরিকার মোহে প্রলুব্ধ হয়ে মৃত্যুপথকে বেছে নিচ্ছে?
আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে দেখবো বেকারত্ব একটি বড় কারণ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করা সত্ত্বেও আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশাল এক অংশ কর্মহীনতা তথা বেকারত্বের বেড়াজালে আঁটকে আছে। কর্মসংস্থানের অভাবে দিশেহারা এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এবং পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। এছাড়াও শিক্ষিত এক বিশাল তরুণের অভিমত যে শুধু ডলারের মোহ নয়, পড়াশোনা শেষে ভালো চাকুরির অভাব, কম বেতন, ব্যবসায় ঝুঁকি-অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে দেশ ছাড়তে চান তারা। তাদের এই অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা। নারীদের ক্ষেত্রেও যেসব বিষয় অবৈধ পথে দেশ ছাড়তে উদ্ধুদ্ধ করে তন্মধ্যে সদ্য তালাকপ্রাপ্ত হওয়া, অল্প বয়স্ক বিধবা, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য হওয়া, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় অপহরণ বা প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাচার করা হয় দেশ-বিদেশে। মানবপাচারের পেছনে আর্থিক দৈন্যদশা অন্যতম কারণ হলেও এক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার রয়েছে বিশাল এক গাফিলতি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হীনতার দৃষ্টান্ত। জাতির জন্য লজ্জা ও অপমানের হলেও মানব পাচার বন্ধে প্রশাসনিক উদ্যোগে কতটা আন্তরিকতা রয়েছে তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। মানবপাচারের মতো জঘন্য লজ্জা থেকে বাঁচতে ২০১২ সালে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হলেও তা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোয় পরিণত হয়েছে। বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা প্রশমনে ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করণে এই আইনের অধীনে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও আজ অবধি তা হয় নি। ফলস্বরূপ ভিন্ন ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য বিচার পেতে বেগ পেতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। কিন্তু যেকোনো বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাই তার গ্রহনযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। মানবপাচার অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয় হওয়ায় ভুক্তভোগীর কাছে সাধারণত এর কোনো দলিল বা নথিপত্র থাকে না। সামাজিক কারণে ভিক্টিমের অনেকেই সামনে আসতে চান না৷ স্বল্পসংখ্যক ভুক্তভোগী রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবিধান চাইলেও আইনের শিথিলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তারা সুবিচারের আশা ছেড়ে দিচ্ছে। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে চতুর দালাল চক্র। যারপরনাই মানবপাচারের লাগাম টেনে ধরা দিনেদিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ঘৃণ্য এই লজ্জা থেকে বাঁচতে আইনের স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি একটা বড় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে তাদের অভিজ্ঞতা ও দুর্দশার কথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলে ধরলে মানুষের মাঝে একটা সচেতনতাবোধ সৃষ্টি হবে। যা মানবপাচার রোধে অত্যন্ত কার্যকর ও দক্ষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
সর্বোপরি মানবপাচারের পেছনে দায়ী দারিদ্র্য, কর্মমুখী শিক্ষার অপ্রতুলতা, স্বল্প শিক্ষা, ভঙ্গুর পরিবার, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অস্পষ্ট অভিবাসী নীতিমালাসমূহকে চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিডিএসও/ জিজাক