অলোক আচার্য্য

  ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

প্রশ্ন ফাঁস ও মেধাহীন প্রজন্ম

চলমান জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর সত্যতা নিয়ে যদিও প্রশ্ন রয়েছে। তবে প্রশ্ন ফাঁসের পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ সুন্দর করে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেসব বর্ণনা দেখে মনে হয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসকারীরা আগের থেকে আরো বেশি কৌশল অবলম্বন করছে। আর এ কাজে তারা ফেসবুক ব্যবহার করছে। এসব খবর প্রকাশের পর কিছু মেধাবী ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এই ফাঁসের দড়িতে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এমন কিছু ভাগ্যবান সুযোগ পেয়েছে যারা আদৌ সেখানে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এর সংখ্যা কত তা বলা সম্ভব নয়। তবে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ফলে আমাদের দেশে মেধা যে মারাত্মক অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক দিন পরেই পিইসি পরীক্ষা শুরু হবে।

প্রাইভেট ব্যবসা অনেক পুরনো এবং এটি বহাল তবিয়তেই চলছে। এখন যেসব ছাত্রছাত্রী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষার আগে তাদেরকে ওই শিক্ষকদের অনেকেই প্রশ্ন বলে দেন। আজ যে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে টাকা। আজকের শিক্ষার্থীদের আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এবেলা ওবেলা তাদের প্রাইভেট কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কোচিং সেন্টারগুলো এবেলা ওবেলা পরীক্ষা নিয়ে এ প্লাস পাওয়ানোর শর্তে ছাত্রছাত্রীদের কোচিং সেন্টারে টেনে আনে। এখানে দায় শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারকে দিলেই হবে না। খানিকটা অভিভাবকের ওপরও পড়ে। যারা দিনরাত লেখাপড়া, বেশি বেশি পরীক্ষা আর পরীক্ষায় অন্তত গোল্ডেন এ প্লাসকে সামাজিক মর্যাদা বলে মনে করেন। তাতে তাদের সন্তান আর যাই হোক না কেন প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষক শিক্ষার। শিক্ষকদের আচার আচরণ, নীতি-নৈতিকতার ওপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রভাবিত হয়। আগেও তাই হয়েছে এখনো তাই হচ্ছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে। কিন্তু নৈতিকতাবিরোধী কাজকর্মের জন্য শিক্ষক সমাজের ওপর দুর্নাম আসছে। আসলে যারা এ ধরনের নৈতিকতাবিরোধী কাজকর্ম করছেন তাদের শিক্ষকের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ শিক্ষক হতে গেলে যে গুণাবলি অর্জন, যে মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন তা তাদের নেই। তাই পেশাগতভাবে তারা শিক্ষকতা করলেও আসলে শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তাদের নেই। তাই গুটিকতক লোভী ও নীতিহীন শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষকসমাজ দায় নিতে পারে না। আজ শিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তার দায় শিক্ষকরা এড়াতে পারেন না। কারণ প্রশ্ন ফাঁস নামক একটি অসৎ কাজের পেছনে গুটিকতক শিক্ষক জড়িয়ে রয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভালো রেজাল্ট হয়তো হচ্ছে, কিন্তু মেধার বারোটা বেজে যাচ্ছে যা তারা বুঝতে চাইছেন না। এভাবে শুধু যে তারা দেশটাকে পিছিয়ে দিচ্ছেন শুধু তা নয়, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তেও নিয়ে চলেছেন। যা কখনই জাতির কাম্য হতে পারে না। তাই শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙে যারা দেশের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছেন তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা আজ জরুরি। আর এমনটাই মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশে সামগ্রিকভাবে একটা সমালোচনা চলছে। অনেক দিন আগে থেকেই মেধাবীদের মূল্যায়ন ও শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা কতটা মেধাবী শিক্ষার্থী বের করতে পারছি তা নিয়েই মূলত প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন মেধা পরীক্ষায় হতাশ করার মতো ফল করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি দেশের জন্য কোনো সুখবর নয়। কিন্তু সেটাই ঘটে চলেছে। কয়েক বছর আগে থেকে অনেকেই দেশে মেধাবীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে জানিয়ে আসছেন। মেধা মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি বিষয় নিয়ে মূলত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রয়োগে দক্ষতার অভাব, পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন এবং অধিকাংশ পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁস এসব এখন শিক্ষার সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। কোনো মতেই যেন এর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। কথায় আছে সর্ষের ভেতরই যদি ভূত থাকে তাহলে এ ভূত তাড়াবে কে! প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীতিহীন কতিপয় কর্মকর্তা ও শিক্ষক। বিবেকহীন এসব অসৎ ব্যক্তির মূল লক্ষ্যই হলো নিজেদের পকেট ভারী করা। এর সঙ্গে আরো জড়িত বড় বড় সাইনবোর্ডের আড়ালে শিক্ষা ও মেধা নিয়ে ব্যবসা করা কোচিং সেন্টার, যেকোনো মূল্যে সন্তানের ভালো রেজাল্ট নিশ্চিত করা কিছু অভিভাবক ও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজেই।

অথচ এই বাঙালিরাই বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বুকে মেধা, দক্ষতা আর গৌরবের স্বাক্ষর রেখেছেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধুলা সর্বোপরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালি এবং বাংলার কথা জ্বলজ্বল করছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়াসহ কত নাম মেধার অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। এই নাম কিন্তু আপনা-আপনি বা হালের রেওয়াজ প্রশ্ন ফাঁস করে সম্ভব হয়নি। প্রকৃত মেধা আর যোগ্যতার বলেই এসব করতে পেরেছি আমরা। আমরা যখন পড়াশোনা করতাম তখন প্রশ্নপত্র ফাঁস তো দূরের কথা স্যারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাগিয়ে আনতেও ভয় পেতাম। ভয় পেতাম এই ভেবে, পাছে আবার অন্য ছাত্ররা বলে বসবে প্রশ্ন না দাগিয়ে আনলে পরীক্ষায় মোটেই ভালো করতে পারতাম না। আর এখন অনেকেই ফোন দিয়ে জিগ্যেস করে, ভাই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে না কি! অবশ্য যারা এই অশুভ প্রক্রিয়া চালায় তারা শুধু জেএসসি বা এসএসসি নয়, বরং চাকরির পরীক্ষাগুলোতেও একই চেষ্টা অব্যাহত রাখে—সে কথা বলাই বাহুল্য। একটি জাতির মেধাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এর চেয়ে আর ভালো উপায় কী হতে পারে? জানি না এর পেছনে কারা জড়িত আর কেনই বা আমাদের আগামী প্রজন্মকে আমরা এমন পঙ্গু করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছি। এতদিন চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমরা ধরেই নেই কোথাও না কোথাও প্রশ্ন ফাঁস হবেই। তবে সেখান থেকে স্কুল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। জাতিকে এভাবে মেধাশূন্য করার পেছনে যারা কাজ করে যাচ্ছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ছাত্রছাত্রী থাকবে, শিক্ষক থাকবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকবে, তবে লেখাপড়া করার বা করানোর খুব বেশি দরকার হবে না। রাত জেগে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ারও দরকার হবে না। আর সেটা হলে আমরাই বিপদে পড়ব।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রশ্ন ফাঁস,কলাম,শিক্ষা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist