রেজাউল করিম খান

  ২৩ জুলাই, ২০১৭

উত্তরা গণভবন ও একটি নামফলক

সম্প্রতি নাটোরের উত্তরা গণভবনের দেয়াল থেকে পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানের নামফলক অপসারণ করা হয়েছে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে সারা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন এই প্রাসাদ দর্শনে আসেন, তাদের মধ্যে কিছু মানুষের কৌতূহল নিরসনের জন্যই এই লেখার অবতারণা।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর বর্তমান নাম ‘উত্তরা গণভবন’। নবাব ও ব্রিটিশ শাসনামলে করদ রাজাদের প্রাসাদ ছিল এটি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় সপরিবারে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার রাজবাড়ীটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান প্রাসাদকে ‘গভর্নর হাউস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার স্মৃতি হিসেবে দেয়ালে তার নামফলক স্থাপন করা হয়।

মোনায়েম খানের জন্ম ১৮৯৯ সালে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। ১৯৬২ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নিয়োগ করেন। ওই বছর ২৮ অক্টোবর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত তিনি ওই পদে বহাল ছিলেন। তিনি আইয়ুব খানের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং ঊনসত্তরের ছাত্র-গণআন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। একাত্তর সালে তিনি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান ফের জিন্দা হয়ে উঠবে’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা তার বনানীর বাড়িতে আক্রমণ করে। এ সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এই অভিযানের নায়ক ছিলেন ১৪ বছরের মোজাম্মেল হক। পরে তাকে ‘বীরপ্রতীক’ পদক দেওয়া হয়। ওই রাতে মোজাম্মেল হকের সঙ্গে ছিলেন আনোয়ার হোসেন বীর প্রতীক। তাদের সাহায্য করেন মোনায়েম খানের গাভীর রাখাল শাহজাহান।

দিঘাপতিয়া জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা রামজীবনের দেওয়ান ছিলেন। ১৭০৬ সালে রামজীবন বাসস্থানের জন্য দয়ারাম রায়কে দিঘাপতিয়ার জমি দান করেন। দীঘি, পুকুর, পরিখাসহ প্রাসাদের অভ্যন্তরে মোট জমির পরিমাণ ৪১ একর। ১৭৩৪ সালে দিঘাপতিয়া প্রাসাদ নির্মিত হয়। প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে বসানো হয় একটি বিশাল ঘড়ি। দয়ারাম রায় ঘড়িটি আনিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। কিন্তু ১৮৮৭ সালের ১২ জুন ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে। ওই সময় নাটোরে চলছিল প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮৭ সালে রাজা প্রমদানাথ রায় প্রাসাদ পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেন। শেষ হয় ১৯০৮ সালে। মূল প্রসাদটি একতলা। ভেতরে দরবার, ডাইনিং ও হলঘর ছাড়াও ৩৪টি কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণে আছে দর্শনীয় বাগান, ভাস্কর্য, ফোয়ারা ও টি হাউস। ছিল রানীমহল। পদ্ম পুকুর, গোল পুকুর, শ্যাম পুকুর, কালী পুকুর, কেষ্টজীর পুকুর ও কাছারি পুকুর নামে ছয়টি পুকুর খনন করানো হয়। নির্মাণ করা হয় নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক শান বাঁধানো ঘাট। আছে কুমার প্যালেস ও প্রাচীন কামান। প্রাসাদের অভ্যন্তরে ইটালিয়ান গার্ডেন ও চারপাশে আছে বিরল প্রজাতির ফুল, বনজ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষরাজি। এখান থেকে ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া ফুলের চারা নিয়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে রোপণ করা হয়। আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পারিজাত, হাপাবমালি, কর্পুর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, নীলমণিলতা, মাইকাস, হৈমন্তী।

১৯৬২ সালে মোনায়েম খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান তখন ছাত্র আন্দোলন চলছিল। ওই সময় এবং ১৯৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলন সমগ্র প্রদেশকে আলোড়িত করে। আন্দোলনের তীব্রতায় মোনায়েম খান ও তার দল মুসলিম লীগের বাঙালি নেতারা বিচলিত বোধ করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার নীল-নকশা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ ব্যাপারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিব ও তার সঙ্গীদের বিচার শুরু হয়। মামলাটি রাষ্ট্রদ্রোহের এবং এর অবধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ওই মামলা ও বিচারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত বাঙালি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গঠিত হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি তারা বৈঠকে মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ১১ দফা ঘোষণা করে। সেখানে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছাড়াও প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি করা হয়। শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। ২০ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে সমাবেশ শেষে একটি মিছিল বের হয় । মিছিলটি শহীদ মিনার হয়ে চানখাঁরপুল পৌঁছালে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ শহীদ হন। ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক। আসাদ-মতিউরের মৃত্যু রাজপথের আন্দোলনকে অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা পূর্ব বাংলায় দিনের পর দিন হরতাল পালিত হতে থাকে। সরকারের ১৪৪ ধারা, কারফিউ, গণগ্রেফতার, নির্যাতনসহ সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে বরখাস্ত করেন। দুই দিন পর নিজেও সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে শাসনক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখে তিনি নাটোরে আসেন এবং দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউসকে ‘উত্তরা গণভবন’ এবং নাটোরকে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী করার ঘোষণা দেন। নির্দেশ দেন একটি টেলিভিশন কেন্দ্র নির্মাণের। সরকারপ্রধানের বাসভবন হবে উত্তরা গণভবন। তার ঘোষণার পর নানা কর্মতৎপরতা শুরু হয়। নির্দেশ মোতাবেক বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপকেন্দ্র নির্মিত হলেও ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ বৈঠক এই গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উত্তরা গণভবনে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক করেছেন। তবে গত আট বছরে কোনো বৈঠক হয়নি। এর আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে ১৯৮০ সালের ১৭ নভেম্বর সেখানে বৈঠক করেছেন। এইচ এম এরশাদ উত্তরা গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন। বেগম খালেদা জিয়াও সেখানে বৈঠক করেছেন।

নাটোরে অথবা উত্তরা গণভবন পরিদর্শনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১৯৮৯ সালে ‘কুমার প্যালেস’ ব্যবহার করতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা সেখানে মোটেল চালু করে। কিন্তু কিছুদিন পরই তারা সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। ২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে উত্তরা গণভবন দর্শনীর বিনিময়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। টিকেটের মূল্য দশ টাকা। উত্তরা গণভবন দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ দর্শনার্থী আসে।

গত ১৫ জুলাই উত্তরা গণভবনের দেয়ালে স্থাপিত মোনায়েম খানের নামফলক অপসারণ করা হয়েছে। এর আগে তার বনানীর ‘বাগ-ই-মোনায়েম’ ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এ সময় মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘বনানী কবরস্থানের পাশে ১০ কাঠা জমি ৫০ বছর ধরে অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিলেন মোনায়েম খান ও তার পরিবারের সদস্যরা।’ ইতিহাসের একাংশ মুছে ফেলা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের স্মৃতিচিহ্ন চিরদিন রয়ে যাবে বাঙালির অন্তরে।

পিডিএসও/হেলাল​

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইতিহাস,উত্তরা গণভবন,মোনায়েম খানের নামফলক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist