প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০১ জুন, ২০২১

অনলাইনে চলছে কেনা-বেচা

নতুন মাদক এলএসডি : আসক্তি বোঝার উপায়

বাংলাদেশে সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের জের ধরে সামনে এসেছে তরুণদের মধ্যে এলএসডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইডের ব্যবহার বাড়ছে বলে খবর বেরিয়েছে। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থী বন্ধুদের সঙ্গে মাদক এলএসডি সেবন করে একজন ডাব বিক্রেতার দা নিয়ে নিজেই নিজের গলায় আঘাত করেন। এতে তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার তদন্তের জেরে পুলিশ আরো যেসব তথ্য দেয় তা হচ্ছে, বাংলাদেশে বেশ কটি চক্র এই মাদক কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে এই মাদক বিক্রি হয় বলেও জানানো হয়। তবে এই মাদকে কারো সন্তান আসক্ত হলে তা বোঝার কতগুলো লক্ষণের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিবিসি সোমবার এ কথা জানায়।

এদিকে মাদক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএসডি গ্রহণ করে ভুল রাস্তা দেখে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া বা অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা নথিবদ্ধ রয়েছে।

এলএসডি কী? যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদকবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ এবং এটি বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়। এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়। সংস্থাটির মতে, এটি মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কার্যক্রম প্রভাবিত করে ব্যবহার, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করে।

এলএসডি নেওয়ার পর সাধারণত মানুষ ‘হ্যালুসিনেট’ করে বা এমন দৃশ্য দেখে, যা বাস্তবে নেই। অনেক সময় অলীক দৃশ্য দেখার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে মানুষ। তবে কেউ এলএসডি ব্যবহার করছে কি না তা বোঝার উপায় সম্পর্কে নানা ধরনের মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ইয়াবা বা হেরোইনের মতো মাদকদ্রব্যের তুলনায় এলএসডিতে আসক্তিকর উপাদান (অ্যাডিক্টিভ প্রোপার্টি) কম থাকে। তবে তার মানে এই না যে, এতে আসক্তি তৈরি হয় না। একাধিকবার বা দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার করতে থাকলে এলএসডির প্রতিও আসক্তি তৈরি হয়। এলএসডি নেওয়ার পর সাধারণত মানুষ ‘হ্যালুসিনেট’ করে বা এমন দৃশ্য দেখে যা বাস্তবে নেই। তবে ব্যক্তিভেদে এই আসক্তির মাত্রা বা এলএসডির প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়।

মেখলা সরকার মনে করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা মাদক হিসেবে এলএসডি গ্রহণ করেন তারা একক মাদক হিসেবে একে গ্রহণ করেন না। বরং অন্য মাদকের সঙ্গে সঙ্গে এলএসডিও গ্রহণ করে থাকেন। তাই অন্য মাদকদ্রব্যে আসক্তির কারণে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য ব্যবহারকারীর মধ্যে দেখা যায় এলএসডির ক্ষেত্রেও বৈশিষ্ট্য অনেকটা একই রকম হয়। আবার অনেকেই নিয়মিত গ্রহণ না করে বরং মাঝেমধ্যে বা কৌতূহলবশত এলএসডি ব্যবহার করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আলাদা করে কোনো বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় না।

ডা. মেখলা বলেন, মানুষ মাদক গ্রহণ করতে থাকলে তার শরীরে এক ধরনের সহনশীলতা তৈরি হয়। অর্থাৎ আগে কোনো মাদক যে পরিমাণ গ্রহণ করলে যতটা নেশা হতো পরে হয়তো সেই একই মাদকে আর সেই আগের মতো নেশা হচ্ছে না। তখন আসক্ত ব্যক্তি অন্য মাদকদ্রব্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এলএসডিও সে ধরনের মাদকদ্রব্য বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, যারা এলএসডি ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে নানা ধরনের হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। তার হয়তো মনে হয় যে সে এমন কোনো রং বা ঘটনা দেখছেন, যা আসলে বাস্তবে নেই। এ ছাড়া নানা ধরনের শব্দও শুনতে পান বলে জানান মিস সরকার।

তবে কেউ যদি অন্যান্য মাদকের পাশাপাশি এলএসডির আসক্তিতেও ভোগেন তাহলে তার মধ্যে নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—

অস্বাভাবিক আচরণ : জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরুপরতন চৌধুরী বলেন, এলএসডি গ্রহণের পর এর কার্যকারিতা সাধারণত ৩-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। তবে অনেক সময় এটি ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও কার্যকর হতে পারে। তিনি বলেন, এ সময় ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। অনেক সময় মানুষ আত্মঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য যদি পরিবারের কারো মধ্যে দেখা যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, যারা এলএসডিতে আসক্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে খুব ছোট ঘটনায়ও সহিংস হয়ে উঠতে পারেন তারা।

ক্ষুধামান্দ্য : এলএসডিতে আসক্ত হলে তাদের মধ্যে ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয় বলে জানান অরুপরতন চৌধুরী।

ঘুমের সমস্যা : ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, এলএসডিতে আসক্তদের মধ্যে ঘুম নিয়ে ব্যক্তিভেদে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। অনেকের মধ্যে চরম মাত্রায় অনিদ্রা দেখা দেয়। তবে অরুপরতন চৌধুরী জানান, অনেকের মধ্যে অতিরিক্ত ঘুমের বৈশিষ্ট্যও দেখা দেয়। কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই ঘুমাতে থাকেন অনেকে।

এলএসডি সেবনের পর অনেক ব্যবহারকারীর শ্রবণ এবং দর্শন ইন্দ্রিয় বেশি সক্রিয় হয়ে যায় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ডা. মেখলা সরকার বলেন, যারা আসক্তিতে ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাতের বেলা তারা না ঘুমিয়ে জেগে থাকেন আবার দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকেন।

শারীরিক পরিবর্তন : অরুপরতন চৌধুরী বলেন, এলএসডিতে আসক্তদের যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তার মধ্যে রয়েছে, চোখের মণিতে পরিবর্তন বিশেষ করে বড় হয়ে যাওয়া, শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এ ছাড়া এলএসডি সেবনের পর অনেক ব্যবহারকারীর শ্রবণ এবং দর্শন ইন্দ্রিয় বেশি সক্রিয় হয়ে যায় বলেও জানান তিনি। এ কারণেই অনেক সময় যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে গান করেন তারা এই মাদক গ্রহণ করে থাকেন বলে জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য মতে, এলএসডি গ্রহণের কারণে দেহে অতিরিক্ত ঘামও হয়ে থাকে।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন : মেখলা সরকার বলেন, মাদকে আসক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যবহারকারীর জীবনযাত্রায় নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি হয়তো কারো সঙ্গে মিশতে চাইছেন না বা বন্ধু-বান্ধবের পরিমাণ কমে যেতে দেখা যায়। অনেক সময় আবার এর বিপরীতও দেখা যায়। আগের বন্ধুদের সঙ্গে না মিশলেও নতুন করে বন্ধুও তৈরি হতে পারে। আর্থিক চাহিদা আগের তুলনায় বেড়ে যেতে পারে। নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার বিষয়ে উদাসীনতা দেখা দেওয়া, ক্লাসে ফাঁকি দেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য দেখা যেতে পারে বলেও মনে করেন মিস সরকার।

মাদকাসক্তিবিষয়ক গবেষক ও ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম ইমদাদুল হক বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, সন্তানরা বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে পড়ছে বা তারা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ইচ্ছা করেই একাকী হয়ে পড়ছে। সে ক্ষেত্রে এলএসডির মতো আসক্তি ধরাটা কঠিন। সে ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে।

ইমদাদুল হক মনে করেন, ঘুমের সমস্যা বা খাবারের অরুচি, নতুন বন্ধু তৈরি মানেই কেউ মাদকাসক্ত নয়। সন্তানদের প্রতি যাতে বাবা-মা অযাচিতভাবে সন্দেহের আওতায় নিয়ে না আসে সেদিকেও লক্ষ রাখাটা জরুরি। আর এ কারণেই বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদক,এলএসডি,আসক্তি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close