পিন্টু রহমান

  ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

জলচিত্র

ঘণীভূত সন্ধ্যার বিশুদ্ধ তন্ময়তায় এক এক করে ডুবে যেতে থাকে পৃথিবীর সব কোলাহল। মেঘগুলোও আর আকাশে নয়; হামাগুড়ি দিয়ে যেন আজগার আলীর অন্তপুরে প্রবেশ করে। এক ফোঁটা বাতাস নেই। বাবলার পাতাগুলো অজন্তার পাথরের মতো স্থির। রসুঁই ঘরের দুয়ার বন্ধ করে হালিমা খাতুন স্বামীর পাশ ঘেঁষে বসে। হাতপাখা নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করে, আইজ খুব গরম পড়তিছে, তাইনা গো রেশমার বাপ?

আজগার আলী নিরুত্তর। এমন বাহুল্য প্রশ্নে সে বিরক্ত হয়। গরম তো সবাই অনুভব করে, শুধু শুধু জিজ্ঞেস করার দরকার কী! তবে বৈশাখের গরম একটু অন্যরকম, আজগার আলীর কাছে অতি মামুলি, নাকের নস্যি মনে হয়। এই উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতে অভিনব পন্থা অনুসরণ করে। তির তিরে গরমে প্রায়ই সে কল্পনার ডানায় ভর করে সোজা বোরো ক্ষেতে হাজির হয়। আইল ধরে চারপাশে হাঁটাহাঁটি করে। সজীব পাতাগুলো নাড়াচাড়া করে। মাতৃগর্ভ ফুঁড়ে ধানের শীষগুলো সবে চোখ মেলে তাকিয়েছে। আভিজাত্যের ভারে কেউবা নুয়ে পড়েছে। আহ, কী সুঠাম দেহ! অকারণেই দুলে ওঠে। আজগার আলীর তখন মনে হয়, ধানগুলো যেন তাকে কুর্নিশ করছে। এরপর আর গরম থাকে না, তনুমনে পেলব সুখানুভূতি খেলা করে।

আজগার আলী একা না; সব কৃষকেরই অভিন্ন জীবনচিত্র। ফসলকেন্দ্রিক আবর্তিত হয় আশা-নিরাশার জোয়ার-ভাটা। ধানগুলো শুধু ধান নয়, নানামুখী সম্ভাবনার ইঙ্গিত। ক্ষেতের পাশে না এসে কিছুতেই সুস্থির থাকতে পারে না। কারণে-অকারণে বারবার যেন শিকড়ের কাছে আসা-যাওয়া! যেদিন হাতে কাজ থাকে না, গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে গড়াগড়ি দেয়, নাতি-নাতনিদের রূপকথা শোনায়। কিন্তু ভরদুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনলেই মনটা উতলা হয়ে যায়। বিছানায় মন বসে না, কাঁধে গামছা চাপিয়ে ক্ষেতের পাশে হাজির হয়। আজগার আলী অনেক দিন লক্ষ করেছে, কখনো কখনো ধানগাছের কচিপাতার আড়ালে ছেলে-মেয়েদের মুখ উঁকি দেয়।

হালিমা খাতুন ঠোঁট চেপে একরাশ বজ্রবাতাস রাতের আকাশে ভাসিয়ে দেয়।

আহা, কত দিন হয় মাইয়্যাডারে দেইখিনি!

হালিমা খাতুনের দীর্ঘশ্বাস তার আর একার থাকে না; আজগার আলীর মধ্যেও সংক্রমিত হয়। হুকায় গুড় গুড় শব্দ তুলে বলে, হ হ্যাঁচা কইছো গো; মাইয়্যাডার লাইগি পরাণ কান্দে। অরে ইবার নাইওর আনুম। যাওনের কালে একখান ঢাকাই শাড়ি আর রেশমি চুড়ি দিউম।

স্বামীর মন-মেজাজ ভালো থাকলে হালিমা খাতুন নিজেও কথার পিঠে কথা লাগাতে ওস্তাদ। আলতা পায়ে যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে যায়, ফিরে আসে। থরে থরে সাজানো স্মৃতিগুলো আলগোছে ছুঁয়ে দেখে। আজগার আলী তখন অবাক চোখে বউয়ের মুখের পানে তাকিয়ে রয়। সংসারের ঘানি টানতে টানতে মানুষটা ক্লান্ত। শরীরের আঁটসাঁট বাঁধন ভগ্নপ্রায়। অথচ ওই বিশেষ মুহূর্তে মনে হয়, রহিমার এতটুকু ক্লান্তি নেই, ঘর-গেরস্থি সামলাতেই তার আনন্দ।

জোনাকিদের সৃষ্ট নক্ষত্রবলয় ভেদ করে আজগার আলীর দৃষ্টি বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। আকাশের কোণে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড়-বৃষ্টির আফঙ্কায় মনে মনে শঙ্কিত। ফসল ঘরে না ওঠা পর্যন্ত এই শঙ্কার অবসান হবে না। এমনিতেই আমন মৌসুমে একমুঠো ধান হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে মাঠঘাট সব ভেসে গেছে, তাই বোরো ক্ষেতেই ভরসা। কিন্তু এবারও যদি ফসল ঘরে না ওঠে, সংসারে দুর্ভিক্ষ হানা দেবে। বেড়ে যাবে এনজিওকর্মীদের আনাগোনা। দেনার দায়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি নিলামে চড়বে। আজগার আলী আর ভাবতে পারে না, ঝিম ধরে বসে থাকে।

হালিমা নিজেও চিন্তিত, তবে তার চিন্তাজুড়ে ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি। ইবার তো ঘরেত খুঁটি লাগাইলি না; ঝড় আসলিই তো সব উইড়ি যাবিনে।

আজগার আলী তাচ্ছিল্যমাখা স্বরে উত্তর দেয়, উড়লি উইড়বো।

হালিমা খাতুন প্রদ্বীপের আলো স্বামীর মুখ বরাবর এগিয়ে ধরে। ওই মুখে একটুও আলো নেই, শ্রাবণ-মেঘের মতো ভার ভার। মনে হয়, এই বুঝি বৃষ্টি নামবে।

হালিমা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, এসব তুমি কী কইতিছো!

আজগার আলীর চেহারায় আত্মপ্রত্যয়ের চিহ্ন, হ, ঠিকই কইতিছি। মুই ধান চাই, বেবাক ধান-কানায় কানায় গোলা ভইরি যাবি, পোলাপান লইয়ি শুহি থাইকুম, ভইর বছর আর অভাব থাকবি না।

টুকরো টুকরো মেঘগুলো হঠাৎই দলবদ্ধ হয়ে নিচে নেমে আসে; আরো নিচে। চক্কর দিয়ে বাতাস নৃত্য শুরু করে। সেই সঙ্গে ধুলাবালি খড়কুটাও যেন প্রাণ পায়। এক ঝাটকায় নিভে যায় প্রদ্বীপের আলো। পাশের বাঁশ বাগান থেকে ভেসে আসে কড়াৎ-কড়াৎ শব্দ। শুধু বাগান নয়; এই শব্দ আজগার আলীর বুকের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়। হালিমা দুহাত দিয়ে সংসারটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাতাসের তান্ডবে চালার খড়গুলো এক এক করে ওড়ে যায়।

ঘরের প্রতি আজগার আলীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মন পড়ে আছে ফসলের মাঠে, ধানের ক্ষেতে। এবারও যদি ফসল নষ্ট হয়, তবে খাবে কী, যাবে কোথায়, বাঁচবে কেমন করে!

ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। আজগার আলী আর ধৈর্যের সঙ্গে পারে না, হালিমার বাঁধা উপেক্ষা করে মাঠের পথে পা বাড়ায়, বিধাতার দরবারে দুহাত তুলে কাকুতি-মিনতি জানায়, করুণা ভিক্ষা চায়-ওরে আমার আল্লøারে, এ কোন গজব নাজেল হইলো গো! ঝড়-বৃষ্টির হাত থ্যন তুমি আমগোর ফসল বাঁচাও, তা না হইলি মইরি যাউম গো।

আজগার আলীর কথা আর আস্ত থাকে না, বাতাসের বহুমুখী অত্যাচারে ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। দিগন্তের সীমানায় ওই শব্দ যেন পুনরায় প্রতিধ্বনিত হয়। এক একটা বাতাস এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। আজগার আলী তবু অপ্রতিরোধ্য। শিলাবৃষ্টির মাঝে অবিরাম পা চালায়; শাঁ শাঁ শাঁ...

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist