জোবায়ের মিলন

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বইমেলা পাঠকের বইমেলা বইমেলার পাঠক

আবার বইমেলা হাজির। গত বছর যারা বইমেলায় এসেছেন, যারা আসেননি, যারা আসি আসি করে আসতে পারেননি, যারা না আসতে চেয়েও এসেছেন বহুবার, যারা বহুবার আসতে চেয়েও আসতে পারেননি শেষ পর্যন্ত তাদের সবার আসা-যাওয়ায় পরিবর্তন ঘটতে পারে। গত বছরগুলোতে যারা এসেছেন তারা এবার নাও আসতে পারেন, যারা আসেননি একবারও, তারা এবার আসতে পারেন অনেকবার। কিন্তু অমর একুশে গ্রন্থমেলাÑ যাকে আমরা বইমেলা নামে ডাকি তাকে আসতে হয়, বইমেলা আসে তার ঠিক সময়ে। ঘরের ব্যস্ততা, পরের প্রয়োজন কোনো কারণ দর্শিয়ে বইমেলাকে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। সে সুযোগ বইমেলা নেয় না। নিতে পারে না।

প্রতি বছর বইমেলা আসতে হয় তার পাঠকের টানে, আগ্রহে। এবারও সেই প্রেমেই তার আগমন। অন্যবারের চেয়ে এবারের পার্থক্য কিছুটা চোখে পড়ে। চার দেয়ালের বাঁধন থেকে বেশ কয়েক বছর আগেই বইমেলা ডানা মেললেও এবার যেন আরো একটু উড়াল। পাখায় আরো একটু হাওয়া লাগানো। থোকা থোকা হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজেকে প্রশস্ত করে উপস্থাপন। বেশ সুন্দর।

বইমেলার ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত বইমেলাকে কোণঠাসা হয়ে থুবড়ে থাকতে হয়নি কখনো। দিনে দিনে এর পেখমে রং লেগেছে। উড়ার শন্তি জন্মেছে। আগা-গোড়ায় বিস্তার ঘটেছে। অনেককে সেই কবে থেকে বলতে শুনছি, বইমেলা চলে না, বইমেলা ম্যাড়মেড়ে, বইমেলা জনশূন্য, বইমেলা অনোন্নত, বইমেলা গেল গেল! বইমেলা কি গিয়েছে? বইমেলা কি পতনে আছড়ে পড়েছে? বইমেলা কি তার স্বরূপ হারিয়েছে? বইমেলা কি বিনাশের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছে? কার কী মত, উত্তর তা জানি না। চাক্ষুশ বিচরণ, অভিজ্ঞতা, নিরীক্ষা ও অবলোকনে মনে হয়নি অমর একুশে গ্রন্থমেলা অর্থাৎ আমাদের বইমেলা নির্জীব হচ্ছে বছর বছর। বরং খোলা চোখে দেখলেও বোঝা যায়, বইমেলা সজীব হয়েছে, হচ্ছে একটু একটু করে।

বইমেলার পাঠক বাড়ছে, না কমছে? এটা নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করার খুব প্রয়োজন আছে কিনা বুঝি না। পাঠকের বৃদ্ধি ও হ্রাস নিয়েও প্রতি বছর শোক-তাপের অভাব হয় না। হায় হায় রবের কমতি হয় না। বিলাপের আওয়াজ পাওয়া যায় সদর রাস্তায়। শুধু বইমেলা চলা সময়ে নয়, সারা বছরই এই আলোচনা বইয়ের দোকানে, লেখক আড্ডায়, প্রকাশনের মেলায়, পাঠক আন্দোলনে গমগম করতে শোনা যায়। আসেন তবে বুকে হাত দিয়ে; দেখেন নিজের সৃষ্টিকর্মের দিকে, চোখ রাখেনÑ যা আপনি রচনা করলেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণসহ নানা আঙ্গিকে; তা আসলে কতটুকু পাযোগ্য! আপনি আপনার সৃষ্টিটির দিকে কি একবার মন দিয়ে নয়ন বুলিয়েছেন? আপনি কি আপনার সৃষ্টির দিকে একবার মনোনিবেশ করেছেন? আপনি কি আপনার লেখাটির দিকে সন্তান স্নেহের মতো করে স্নেহ দিয়েছেন? খেয়াল করুন, নাকি আপনি যা সৃষ্টি করলেন তাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনে করে গোঁফে তাও দিয়ে লাফাতে লাফাতে পাড়ায় ঢোল বাজিয়ে, দৈনিকের দরজায়, সম্পাদকের সেলফোনে, প্রকাশকের কারখানায় ঢুঁ দিতে দিতে পায়ের জুতা জোড়া ক্ষয় করেছেন অধিক? আপনি যখন যা-ইচ্ছা; তা তৈরি করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে চাইছেন বা একপ্রকার প্রতারণা করছেন, তখন যখন পাঠক এক পাতা পড়ে যথাস্থানে রেখে অন্য বইয়ের মলাট উল্টাচ্ছে আর আপনি তার গা ঘেঁষে তাকে কনভেন্স করার চেষ্টায় রত, তখন কোনো ভাবনা কি আপনার মনে এসেছে? বইমেলায় এমনও দৃশ্য তো দেখা যায় যে, একটি বই পাঠকের হাতে ধরিয়ে দিতে এক-দুই-তিন ঘণ্টা তার পিছু পিছু ছুটছেন লেখক! আরো হাজার হাজার উদাহরণ তো পাঠক আপনার কাছেই আছে। তবে কেন সন্দেহ প্রকাশ করছেন পাঠক বাড়ছে না কমছে? একজন যোগ্য লেখককে তো কখনো এমন সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা যায় না! একজন পরিশ্রমী পড়–য়া লেখককে তো এ নিয়ে বাকবিতন্ডা করতে শোনা যায় না! যার লেখায় শান আছে, যার লেখায় চমক আছে, যার লেখায় নতুনত্ব আছে তাকে তো কারো পিছু পিছু সময় নষ্ট করতে হয় না! তবে আপনাকে কেন? যার বই বিক্রি হচ্ছে না, চলছে না তাকেই তো কান্না করতে দেখা যায় যে, বই চলছে না, বই পড়ছে না কেউ, বই কিনছে না কেউ, বইয়ের পাঠক চলে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে! নিজের কাছে কি জানতে চেয়েছেন, আপনি কতটুকু পড়েন প্রতিদিন? নিজের বই না চলা মানেই পাঠক কমছে এমন নয়। আবার নিজের বই চলা মানেও পাঠক বাড়ছে এমনও নয়। বিগত কিছু বছরের সারাংশ একসঙ্গে করলে বিষয়টি নানা দিক থেকে হিসাব কষে সহজেই বলা যায়। এ নিয়ে হা-হুতাশ করার তেমন কিছু নেই। আনুপাতিক হারে কম বেশি হবে, প্রতি বছর একই রকম হবে না এই সত্যতা মানতেই হবে। পাঠক বাড়ছে না কমছে এই হিসাব সত্যিকার অর্থে মিলাতে হলে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন নানা আঙ্গিক থেকে। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে, তত্ত্বে ও তথ্যে পাঠকের সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর খুব বেশি দুরবস্থা তৈরি হয়নি বইমেলায়। বইয়ের পাঠক কখনোই বাণিজ্য মেলার পণ্যের ভোক্তার মতো ছিল না। কখানো হবেও না। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বই পড়তেন, পড়েন, পড়বেন। এই পাঠককে ঠেলেঠুলে সরানো যাবে না। আবার নতুন পাঠক টেনেটুনে আনাও যাবে না। সময়কে নির্ভর করে, পৃথিবীর চলমান গতির সঙ্গে গতি রেখে আপনা আপনি থেকেই বইয়ের পাঠক তৈরি হয়। পৃথিবীতে যত দিন জ্ঞান ও জ্ঞানের প্রয়োজন থাকবে তত দিন পাঠক থাকবে। ইতিবাচক দৃষ্টিতে এই পাঠক বাড়ানোর পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে কৌশলে নিতে হবে, পাঠক কমার কারণগুলো নিয়ে মাঠে কাজ করে এর সমাধান বের করতে হবে। আপাতত দুশ্চিন্তা করার আহামরি শঙ্কা দেখা যায় না। পাঠকের মনে ভয় ধরিয়ে পাঠক যারা নষ্ট করতে অতি উৎসাহী তাদের হিসাবটাও কড়ে গুনে রাখতে হবে, হিংসার আগুনে যারা ফুঁ দেন তাদের মুখ ভুলে গেলে ক্ষতি বইমেলারই।

আমাদের বইমেলায় বইয়ের মান কি আসলে খুশি করতে পারে পাঠককে? পারলে কতটুকু পারে? আদিকাল থেকে আজ অবধি যা শ্রেষ্ঠ, যা ভালো বলে ঠাওর করি, তা আসলে কতটুকু ভালো? তা কি অনশ্বর? ভালোর কি সত্যি সত্যি কোনো অভেদ্য মাপকাঠি আছে? মেলা মানেই মিলনমেলা। মেলা মানেই উৎসব। মেলা মানেই আনন্দ। মেলা মানেই কিছু ছাড়। কিছুটা ছেড়ে দেওয়া। মেলার নিয়ম যদি হয় স্কুল শিক্ষকের বেতের আগার মতো, তাহলে সে মেলার আনন্দটা কোথায় থাকবে বা কোথায় দাঁড়াবে, তা এ মুহূর্তে ঠিক চিহ্নিত করা কঠিন। মেলা যেহেতু উন্মুক্ত, মেলা যেহেতু খোলা আকাশের নিচে বন্ধন; সেহেতু চেনা-অচেনা হাত এসে এখানে করমর্দন করবে, তা আটকানো দুরূহ। যদি আটকানো হয় তবে মেলা রস হারাবে নিশ্চিত। এটাই মনে হয়। অন্যের অন্য কিছু মনে হতে পারে। ছোটবেলা থেকে গাঁয়েগঞ্জে নানা মেলা দেখে আসছি। মেলায় পণ্য আসে। চারদিক থেকে হরের প্রকাশ পসরা নিয়ে বিক্রেতা দু-চার আনা লাভের আশায় বাঘের মাথায় ছাগলের চুল বসায়, গরুর মাথায় সিংহের কেশর লাগায়, টিনের ছোরায় স্পাতের রং মাখে তো প্লাস্টিকে লোহার বরণ! যেহেতু তারা লাভ করতে আসে, সেহেতু তারা কৌশল করবেই। শত নিয়মনীতি থাকলেও তারা তা ছিঁড়তে চাইবে, আড়ালে-গোপনে এমন ফন্দি করবে, যেন কিছু কামাই আসে। বইমেলাকে এই থেকে অনেক তফাতের দেখি না। ওই যে বললাম, এটাই মনে হয়, অন্যের অন্য কিছু মনে হতে পারে। বইমেলায় ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, পচা-গলা, কাঁচা-পাকা, স্বাদ-অস্বাদ, উচ্চ মান-নিম্নমানের সবকিছুই উজ্জ্বল রং নিয়ে হাজির হয় দাপটের সঙ্গে। প্রকাশকও জানেন তার দোকানে কোনটা কী। লেখক জানেন কোনটা কী। এ ক্ষেত্রে পাঠককে জানতে হবে কোনটা কী। নিয়মিত পাঠকরাও জানেন কোনটা কী। আবারও বলি, ওই যে বললাম, মেলায় ভালো-মন্দ, স্বাদ-অস্বাদ, তেঁতো-কষ্টি সবই ওঠে; এমনিভাবে বইমেলায় নিয়মিত পাঠক, অনিয়মিত পাঠক, শখের পাঠক, লোক দেখানো পাঠক, অভিনেতা পাঠক, উৎসাহী পাঠক, অতি উৎসাহী পাঠকসহ হরেকরকম পাঠক ভিড় করে। এ ক্ষেত্রে পাঠককেই যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করতে হবে কোনটা টিন, কোনটা স্পাত। শখের পাঠক যদি রং দেখে আর ছবি দেখে এবং মলাট দেখে আর বাহারি নাম দেখে বই সংগ্রহ করেন আর পাঠ করতে গিয়ে দাঁত ভাঙেন; শেষে অভিযোগ করেন তিনি ঠকেছেন, ইহা মানসম্পন্ন বই না আর সে দায় যদি এসে প্রকাশক বা বইমেলার ওপর পড়ে, সে দায় কে নেবে? তবে এও অসত্য নয় যে, প্রকাশকের কোনো দায় থাকে না। প্রকাশকেরও দায় থাকে। প্রকাশকদের বেলাও পেশাদার-অপেশাদার, নৈতিক-অনৈতিক, দায়িত্বশীল-অদায়িত্বশীল প্রকাশকের অভাব নেই। সে কারণে বইমেলা বা বইয়ের ব্যবসা যেহেতু রুটি-বিস্কুটের ব্যবসা নয়, সেহেতু প্রকাশকে নজরে রাখতে হবে তিনি কেমন বই প্রকাশ করছেন। আদতে সে বই পড়ে যেকোনো পাঠকই শেখার কিছু পাবেন কি না। নাকি অকারণ খরচ বলে আক্ষেপ করবেন। যদি তাই-ই হয়, তবে প্রকাশককে মনে রাখতে হবে, আজ আপনি একজন পাঠককে ঠকালেন মানে আগামী দিনে আপনি কয়েকজন ক্রেতা হারালেন এবং আপনার মতো অন্য প্রকাশকরাও তাই-ই হারাল। কেননা যে শখের পাঠক না জেনে, না চিনে কেবল রং দেখে বই কিনে ঠকলেন, সে পাঠক আসলে ওই শখের জায়গা থেকেও সরে গেলেন। প্রকাশকের উচিত অপাঠককেও পাঠের কাছে আনার পথ সরল করা। পাঠকেরও উচিত জেনেশুনে পাঠযোগ্য বই ক্রয় করা। লেখকেরও উচিত এমন কিছু লেখা, যা মানুষ পাঠ করে কিছু না কিছু পায়। হোক সে আনন্দ, হোক সে নিখাদ জ্ঞান, হোক সে জানা-শোনার নতুন কিছু। আর যাই হোক, লেখক-প্রকাশক, বইমেলা মিলে পাঠকের মনে যেন বিতৃষ্ণা জাগিয়ে দেওয়া না হয়। পাঠকের বিতৃষ্ণায় ক্ষতি নির্দিষ্ট কোনো এক পক্ষের না। এ ক্ষতি সবার। এ ক্ষতি একটি বাঙালি সংস্কৃতির।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close