মহীবুল আজিজ

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

কামাল চৌধুরীর কবিতা

দীর্ঘ পথ-হাঁটার বৃত্তান্ত

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যে নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দেয় তার প্রাণাবেগময় বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে। আগে থেকেই যারা লেখালেখিতে ব্যাপৃত ছিলেন তাদের সাহিত্য বরণ করে নিল এক রূপান্তরকে। আর যারা লেখালেখির পাশাপাশি কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন সাহিত্যের কাজকে কিছুকালের জন্য স্থগিত রেখে তাদের প্রত্যাবর্তন আরো বিস্ময়ের। যেহেতু বাজি রেখে যুদ্ধে যাওয়া জীবনটাকে তারা ফিরে পান অভূতপূর্ব সঞ্চয়ের মাত্রাসহ। ফলে তাদের সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ হলো সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে। নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ তাদের কবিসত্তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় উইলফ্রেড ওয়েন, সিগফ্রিড স্যাসন, রুপার্ট ব্রুকসহ সেসব কবিকে যারা যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে যুদ্ধোত্তর সাহিত্যের বাস্তবতায় পরিণত করেন। তারা যুদ্ধ-পূর্ব এবং যুদ্ধোত্তর এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে সংযোগসেতু হয়ে দেখা দেন। তাদের উত্তরসূরি হয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের প্রথম দশকে সৃজনশীল সাহিত্যমঞ্চে প্রবেশ করেন তারা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা-স্নাত। তারা স্বপ্নমুখী নবসৃজনে উন্মুখ এবং স্বাধীনতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তিকে সমন্বিত করার প্রশ্নে দ্বিধাহীন।

কবি কামাল চৌধুরী বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রাথমিক স্বাতন্ত্র্যে খচিত। তিনি এবং তার সমকালের ও সমগোত্রীয় কবিরা একাত্তর-পরবর্তী দশকটিকে তাদের সৃষ্টিতে যেমন স্মরণীয় করে রাখেন, তেমনি এই দশকটিও কামাল এবং তার সহযাত্রীদের দেয় ভিন্নতর নির্মিতি। তারা কেবল যুদ্ধের তাপ ও শক্তিকেই ধারণ করেন না, যুদ্ধপ্রভাবিত সবটা বলয়কে আত্মস্থ করার চেষ্টা থাকে তাদের। এ তো অনস্বীকার্য, যুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের ওপরই প্রত্যাশা থাকে সর্বাধিক। কামাল চৌধুরী এবং তার সহযাত্রীরা, বলা বাহুল্য সেই প্রত্যাশাকে নিজেদের মানসে স্পষ্টচিহ্নিত রেখে বিকশিত হতে থাকেন। কামাল চৌধুরীর একেবারে প্রথম কবিতাটি পুরোপুরি উদ্ধার করা গেলে ভালো কিন্তু আমি সেটির কয়েকটি লাইন উৎকলন করবÑ করব এ জন্য যে, তাতে তার কাব্যিক অভীপ্সা সন্দেহাতীতভাবে প্রকটিতÑ ‘একজন মাঝি যদি পাল ও বৈঠার প্রেমে/আমার কবিতা থেকে গান তুলে ছুড়ে দেয় মুগ্ধ হাওয়ায়/মুক্তিযোদ্ধারা যদি মৃত্যু ও বারুদের ঘ্রাণে/ভালোবাসে আমার কবিতা/আমি সেদিন বলব/সমস্ত প্রার্থনা আজ শেষ হয়েছে/জন্মের ঋণ আমি স্বীকার করেছি।’ (জন্মের প্রার্থনা)

যার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম মিছিলের সমান বয়সী তার হৃদয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য থাকে একটি সংরক্ষিত স্থান, যেটিকে তিনি উত্তরোত্তর লালন করে যান। সেই অঙ্গীকার থেকেই তিনি বিদীর্ণতার মধ্যেও দেখতে পান এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা।

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটিকে কামাল চৌধুরীর কাব্যকর্মের প্রেল্যুড বলে বিবেচনা করলে স্বয়ং কামাল চৌধুরী হয়ে ওঠেন সত্তরের মুখপাত্র-প্রতিনিধি। সত্তরের সামগ্রিক কাব্য-সংগঠনের সব উপাদান কম-বেশি কামাল চৌধুরীর কবিতায় উপস্থিত। এসবের মধ্যে তার স্বতন্ত্র আছে এবং রয়েছেন সত্তরের আরো স্বাতন্ত্র্য-ভাস্বররাও। চকিত চয়নে এ রকম কয়েকজন কবির নামোল্লেখ করা যাক যাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে, সত্তরে, স্বাধীন মানচিত্রে। অরুণাভ সরকার, জুলফিকার মতিন, মাহবুব সাদিক, আলতাফ হোসেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হুমায়ুন আজাদ, সমুদ্র গুপ্ত, আবিদ আনোয়ার, দাউদ হায়দার, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, শিহাব সরকার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল¬াহ, ময়ুখ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, মোহন রায়হান, নাসিমা সুলতানা, মুজিবুল হক কবীর, মাহবুব হাসান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালÑ তারাও কামাল চৌধুরীর মতো একাত্তরের অব্যবহিত-পরবর্তী চেতনাজাত। রুবী রহমান, সাযযাদ কাদির, সানাউল হক খান, হেলাল হাফিজ, জাহিদুল হক, তুষার দাশ, মুহাম্মদ সামাদ, মিনার মনসুর, নাসির আহমেদসহ আরো অনেকের নাম করা যাবে যদিও তাদের কারো প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ পায় মুক্তিযুদ্ধের অল্প আগে, কারো বা খানিকটা বিলম্বেÑ আশির দশকে। কামাল চৌধুরী তার কাব্যিক অভিযাত্রায় একা ছিলেন না, বলা যায় তিনি ছিলেন এক সম্মিলিত কোরাসে। কিন্তু কোরাস ছাপিয়ে একসময় তার স্বরের স্বাতন্ত্র্য বা স্বাতন্ত্র্যের স্বর ঠিকই হয়ে ওঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়।

কোনো কাব্য-সমালোচক যদি প্রশ্ন করেন, সত্তরের কবিদের কবিতায় এত দাহ-দ্রোহ-ক্ষোভ কেন তাহলে বলতে হবেÑ সেই সমালোচক উত্থাপিত প্রশ্নটি সঙ্গত। কিন্তু এর জন্য দায়ী সত্তরের কবিরা নন, দায়ী তাদের পরিপার্শ্ব-বাস্তব। স্বাধীনতা ও মুক্তির বোধ একটি জনপদের কোটি কোটি মানুষের প্রাণে জাগায় নতুন জোয়ারের স্পন্দন। আর সেই জনগোষ্ঠীর শব্দশিল্পী তথা কবিরা সেই জোয়ারের স্পন্দনকে কাব্যে অনুবাদ করার অপেক্ষায় থাকেন। বলা যায়, স্বপ্ন থেকে বাস্তব হয়ে যাওয়া রূপকল্পকে ভাষায়িত করার জন্য তারা তখন উন্মুখ। কথা থাকে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া জনপদের ভাষাকে কবিরা পরিণত করবেন কাব্যোচ্ছ্বাসে। অথচ সেই প্রত্যাশা মার খায় প্রচ-ভাবে। সেই ইতিহাস লেখা থাকে ইতিহাস-গ্রন্থে আর কামাল চৌধুরীর কবিতায়। স্বাধীনতার সাত বছর কালের দূরত্বে এসে তাকে বলতে হয়Ñ‘এই দেশে আমি আছি রক্তভেজা এই জনপদে/সহস্র মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়ে যায়.../শহিদ মিনারগুলো দ্যাখো আজ বিষণœ মলিন.../সব পাখি উড়ে গেছে, সব প্রেম সন্ত্রস্ত হরিণী/ব্যাঘ্র লালসার কাছে প্রতিদিন খুন হয়ে যায়/প্রতিদিন ভালোবাসা একা একা শুধুই পালায়।’ (রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা)

কামাল চৌধুরীর এমন কাব্যোচ্চারণ আরো অর্থপূর্ণ-যৌক্তিক বলে প্রতিভাত হবে, তার পাশাপাশি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল¬াহ, ফরহাদ মজহার, মিনার মনসুর, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবির কবিতা পাঠ করলে। কেন স্বাধীনতা অর্জনের পরও কবিকে বলতে হয় স্বর্ণগ্রাম ফিরে চাওয়ার কথা, কেন কবি পান বাতাসে লাশের গন্ধ। একটা ভয়ংকর করাল-আগ্রাসী কালপ্রবাহকে মোকাবিলা করার জন্য ব্যাপক কাব্যায়োজন নিয়ে অতন্দ্র থাকতে হয় সত্তরের এই কবিদের, যারা মুক্তিযুদ্ধের পরিণামে একটি প্রসন্ন পটভূমির

প্রত্যাশায় ছিলেন।

সত্তরের অধিকাংশ কবির কবিতা তাই প্রত্যক্ষ-সরাসরি-যন্ত্রণাক্লিষ্ট এবং উত্তাপপ্রধান। যে-বাস্তব হিংস্র নখদন্তসহ বিশ্রী চিত্রকল্পে আগুয়ান সেটিকে ঠিক-ঠিক ফুটিয়ে তোলার জন্য কবিদের প্রয়োজন পড়ল প্রতীক-রূপকের পরিবর্তে প্রত্যক্ষতা এবং বক্তব্যময়তা। তবে সেই প্রত্যক্ষতা এবং সেই বক্তব্যময়তা কামাল চৌধুরী ও তার সমকালীন অনেক কবির কবিতায় সঞ্চারিত করে এক নতুন রসের। সেই রস মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দশকের ভাবোত্থিত, সেই রস অঙ্গীকারবদ্ধ কবিদের নির্ভীকতার স্বাক্ষরও। এখানে কামাল চৌধুরীর একটি কবিতার উলে¬খ প্রত্যাশিতÑ ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’। কবিতাটি রচিত হয় ১৯৭৮ সালে। শোকস্তব্ধ-বাকরুদ্ধ-বিস্ময়াভিভূত একটি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত জীবনজিজ্ঞাসার অনবদ্য এক শব্দশিল্প তার এই কবিতা। কবিতাটি শুধু কবির বিশেষ এক হৃদয়াবেগের বার্তাবাহীই নয়, এটি তার দারুণ সাহসেরও দৃষ্টান্ত। যে জাতি অসীম বীরত্বে গোলামির শিকল ছিন্ন করে শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে বিজয়, সে-জাতিই ফের হয়ে ওঠে নির্লজ্জ হন্তারক-খুনি। সেই মারাত্মক বেয়াদবির কর্মকা-কে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাতে হয় কবিকেই। সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে রচিত কামাল চৌধুরীর কবি-সাহসিকতার কবিতাটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধার করা যাকÑ ‘তীব্র প্রতিশোধ আমি ছুড়ে দিই খুনিদের মুখে/দ্যাখো, আগুন জ্বলছে আজ শুদ্ধ সব বাঙালির বুকে/এখন স্বদেশে চাই, শুধু চাই/তোমার সৈনিক কিছু সবল গোলাপ।.../যেখানে ঘুমিয়ে আছ, শুয়ে থাক/বাঙালির মহান জনক/তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ/শৌর্য আর অমিত সাহস/টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো/তোমার সাহস নেবে/নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা।’

কবিতাটির রচনাকাল ঠিক সেই সময়ে যখন খুনি-হন্তারকদের সাংস্কৃতিক পরিম-লে আচ্ছন্ন সব দিক। সেই বৈরী-হননাগ্রাসী সময়ে কামাল চৌধুরীর কবিতাটি পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। এখানেই একই প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করতে হবে কামাল চৌধুরীর খানিকটা আগে রচিত নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি। কামাল এবং গুণ দু’জনের কবিতা দুই ভিন্ন ভাবের বাহক হলেও দুটোই সাহস এবং দায়বোধের অনন্য নজির। কামালের কবিতা উদ্দীপক-রৌদ্রময় এবং গুণের কবিতা বিষণœতা ও শমময়। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তার নির্মম হত্যাকা- নিয়ে আরো কবিতা রচিত হয়েছে কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ এবং কামাল চৌধুরীর কবিতা দুটি বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যে একটি বিশেষ সময়ের সাহসী প্রতিনিধি বলে বিবেচিত হবে সর্বদাই।

সেই সাহসে আস্থাশীল বলেই বন্ধু-সহযাত্রীর সাহসকেও সম্মান জানান কবি। এক কবির শব্দে ঝলকে ওঠে আরেক কবির গৌরবÑ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রয়াণে তার স্মরণে রচিত কামাল চৌধুরীর কবিতাটি সত্তরের অঙ্গীকার-সচেতন সব কবির প্রতি এক ধরনের ‘হোমেজ’ বলে গণ্য করা যায়। এই কবিতাটির মধ্য দিয়ে রচয়িতা স্বয়ং এবং তার উদ্দিষ্ট’র সত্তা দুই-ই ঝলসে ওঠে আলোকের সম্পাতে। ‘কলমের মতো মহাকাল ছোঁয়া বাঁশি/ বাজাতে বাজাতে তামাটে রাখাল তুই/এই শহরের তূর্যবাদক হয়ে/নেমেছিলি পথে কবিতার সন্ন্যাসী.../নিয়ন্ত্রণের গর্বিত গ্রীবা তুলে/থামাতে চেয়েছে ‘পথ ছেড়ে সরে দাঁড়া’/তোর মনে আছে কেমন বৈরী দিন/ধ্বংস পাহাড় উঠে আসে নদীকূলে.../যারা ছিল পথে ছিটকে পড়েছে তারা/একাকী পথিকÑ সঙ্গী ছিল না কেউ/বেদনার মতো দীর্ঘ হয়েছে দিন/শোনা গেছে তবু দ্রোহী কবিতার নাড়া।’ (রুদ্র তোর স্মৃতি)

সত্তর-আশি এবং নব্বইয়েরও অনেকটা কাল বাংলাদেশের কবিতা গণতন্ত্র-মানবাধিকারের সংগ্রামে ধাবমান জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার যে-অঙ্গীকারের প্রমাণ রাখে তার সজোর ঘোষণা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী হয়ে পরবর্তীকালে অন্যদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। রুদ্র এবং কামালের কবিতার স্পষ্ট বক্তব্যপ্রধান প্রায় নিরাভরণ অথচ গভীর ব্যঞ্জনার কবিতা আমাদের কাব্যে আনে এক নবজাগ্রত দ্বীপাভাস। মানববিরোধী করাল কালে কবিতাকে দুরূহ-দুষ্পাঠ্য প্রতীকে-অলংকারে আবৃত করার চেয়ে লোরকা, নেরুদা, কার্দেনাল, পাররা প্রভৃতি কবির কবিতার মতো সময়কে ধারণ করে সময়ান্তরে যাওয়ার চেতনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির প্রথম দশকে যে-তীব্রতা নিয়ে আবির্ভূত হয় তা পরে আর সঙ্গত কারণেই পরিদৃষ্ট হয় না। মানবিকতার ওপর চাপ-পীড়ন এসবের মাত্রা যত জোরালো হয়েছে, আমাদের কবিদের কবিতাও হয়েছে তত প্রখর এবং মর্যাদাসম্পন্ন। মানুষ এবং তার মৌলিক অধিকারের প্রশ্নকে কবিতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করেছে। কামাল চৌধুরীর কাব্যে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে, যে-কবিতাগুলো রচিত হয় এ দেশের দুঃসহ-অবরুদ্ধ আর রাহুগ্রস্ত কালে।

কামাল চৌধুরী তার সমকালীন কবিদের চেয়ে অনেক বেশি সংঘবদ্ধতার অনুগামী। শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, নিম্নবর্গ এসব বিষয়ের কবিতায় কবির কণ্ঠ অধিকারবঞ্চিত মানুষের গান গায়। হয়তো সে জন্যই বিদ্রোহী কবিকেই তার প্রয়োজন চরম দুর্দিনেÑ ‘শুধু কবি নয়Ñ চাই এক বিশাল হৃদয়/চাই এক জ্বলজ্বলে অগ্নিকু- কবিতার/এরকম স্বপ্ন দেখে দেখে অসহায় মানুষের/মনে পড়ে, আপনাকে বড় বেশি মনে পড়ে।’ (নজরুল-এর উদ্দেশে)

লেখাটির ভেতরে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা বলতে যে-আবহকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সেই আবহের সবচেয়ে পরিস্ফুটিত ও প্রকটিত রূপটিকে সাংখ্যিক অবয়বে প্রকাশ করলে সেটা এমন দাঁড়ায়Ñ ১৯৭১Ñ১৯৮১। এই দুই কালবন্ধনীর মধ্যে জমাটবদ্ধ হয়ে রয়েছে পরস্পর-সন্নিহিত বিস্ফোরণোন্মুখ বিচিত্র উপাদান। সেসব উপাদানকে আমরা পঙ্ক্তিবদ্ধ দেখতে পাই কামাল চৌধুরীর কবিতায়। সেসব উপাদানকে আমরা দেখতে পাই তার সমকালীন আরো অনেক কবির কবিতায় কিন্তু কামাল চৌধুরীর কাব্যোপাদান তার মন-মননের সমীকরণে ভৌতাবস্থাকে রূপান্তরিত করেন রাসায়নিক অবস্থায়। তাই তার ‘ক্রাচের যুবক’, ‘সেই মুখখানি কবিতার বড় ছিল’, ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’, ‘হাসান হাফিজুর রহমান’, ‘শহীদ জননী’, ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২’ প্রভৃতি কবিতা বর্তমানতার বাস্তব বা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তব থেকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথা ধ্রুপদী বাস্তবের প্রতিফলক হয়ে যায়। এসব ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যারা বছরের পর বছর পেছনে ফেলে এসেছি সামনে যাওয়ার যাত্রায় তারা লক্ষ না করে পারেন না যে, কামাল চৌধুরীর কবিতা আমাদের এক দীর্ঘ পথ-হাঁটার বৃত্তান্ত হয়ে দাঁড়ায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close