প্রতীক ইজাজ

  ২৬ জুলাই, ২০১৭

এইচএসসির ফল বিপর্যয় : শিক্ষাবিদদের অভিমত

প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে দিকনির্দেশনার অভাব

গত বছরের তুলনায় চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় সার্বিক পাসের হার ও জিপি-৫ দুটোই কমেছে। সব বোর্ডেই মানবিক বিভাগের ফল খারাপ। এর মধ্যে কেবল ইংরেজি বিষয়েই ফেল করেছেন কুমিল্লা ও যশোর বোর্ডে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী। কুমিল্লা বোর্ডে ইংরেজিতে ফেল সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে যশোর বোর্ডে ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করতে পারেননি। একদিকে যেমন বেড়েছে শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা; তেমনি গত বছরের মতো এবারও অর্ধেকে নেমে এসেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এমনকি এই ফল বিপর্যয় গত নয় বছরের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি।

এ নিয়ে গত রোববার ফল প্রকাশের পর থেকেই নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেন এই ফল বিপর্যয়—চলছে কারণ বিশ্লেষণ। কারণ চিহ্নিত করেছে সরকারও। সেখানে বলা হয়েছে, পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন। প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীক্ষা কেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণেও আগের বছরের চেয়ে কম পাস করেছেন।

তবে ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়, এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘এই বছর এইচএসসির রেজাল্ট একটু খারাপ হলেও আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করে গড়ে তুলে এর গুণগত মানের দিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রয়োগ করেছি। কত পার্সেন্ট পাস করেছে, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। সব বিষয়ের প্রতি বিশেষ করে উত্তরপত্র মূল্যায়নে নজর দেওয়া হয়েছে; যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। একইভাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে চলতি বছর পাসের হার কমেছে।

শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে পাসের হার কমার পক্ষে থাকলেও গুণগত মান বৃদ্ধিতে নিশ্চিত হতে চান। তবে তারা এমনও বলছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে যে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। অবশ্য তারা একমত হয়েছেন যে, একবার কমছে, একবার বাড়ছে। পরীক্ষার ফলাফল বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। শিক্ষার মান ভালো হচ্ছে না।

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিগত নয় বছরের তুলনায় এবারই ফল বিপর্যয় ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এ বছর পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা আগের বছর (২০১৬) ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। আবার ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাত বছরে পাসের হার বৃদ্ধি ছিল প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে ২০০০ সালে যেখানে পাসের হার ছিল ৩৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, সেখানে ২০০৬ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৬৫ শতাংশে।

পাসের হার কমার ও বাড়ার এই অস্বাভাবিক পরিসংখ্যানের বিষয়ে শিক্ষাবিদদের মত, শুরুর দিকে জিপিএ-৫ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল। পেয়েছেও। এবারও সে প্রতিযোগিতা ছিল বটে, কিন্তু নতুন পদ্ধতি ও মান বণ্টনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তারা ফল বিপর্যয়ের জন্য বারবার পরীক্ষা ও খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনকে দায়ী করেন। তারা জানান, ২০১৭ সাল থেকে এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নে ১০ নম্বর বৃদ্ধি ও বহু নির্বাচনী প্রশ্নে ১০ নম্বর কমিয়ে আনা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে পরীক্ষার সময় বণ্টন। এমনকি বহু নির্বাচনী ও সৃজনশীল পরীক্ষার মধ্যকার ১০ মিনিটের বিরতিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ মাত্র দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পরীক্ষায় এসব প্রশ্নের উত্তর লেখা কী যে কঠিন, তা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মান বণ্টনের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেননি। তাছাড়া একবার কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, আরেকবার বোর্ডভিত্তিক। একবার কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, আরেকবার সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে। এর ফলে পরিবর্তিত পদ্ধতি ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছেন না শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার ফলাফলে উত্থান-পতন ঘটছে।

ফল বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ইংরেজিতে তুলনামূলক খারাপ ফল। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে এবার ইংরেজিতে ফেল করেছে ২৭ হাজার ৪৬১ জন। গতবার এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ১১৩ জন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে এবার ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করতে পারেননি। একইভাবে ইংরেজির কারণে ফলাফলে বিপর্যয় ঘটেছে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডেও। ইংরেজিতে ফল বিপর্যয়ের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে মানবিক বিভাগে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার কমেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, চলতি বছর নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। বোর্ড থেকে পরীক্ষকদের মডেল উত্তর ও নম্বর প্রদানে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছিল। আগে যেমন পরীক্ষকরা নিজের ইচ্ছায় নম্বর কম-বেশি দিতে পারতেন, এবার সেটা হয়নি। তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান পরীক্ষকদের ওপর এবার অনেক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। মোট খাতার ১২ শতাংশ প্রধান পরীক্ষকদের বাধ্যতামূলকভাবে দেখতে হয়েছে। তাকে নিজের দেখা খাতার নম্বরও পাঠাতে হয়েছে। ক্রস চেক করার জন্য ওই ১২ শতাংশ খাতা আমরা আবার তৃতীয়পক্ষ দিয়ে মূল্যায়ন করেছি। এ ছাড়া পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে সরকারের কঠোর অবস্থানও কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।’ সব বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন হওয়াকেও একটি কারণ হিসেবে মনে করেন তিনি।

ফল বিপর্যয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। এই সংখ্যা বাড়বে কেন? তার মানে সেখানে ভালো শিক্ষা দেওয়া হয় না। একইভাবে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমছে। সেটি কমবেইবা কেন? তার মানে সেখানে গাফিলতি হচ্ছে। তবে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা হয়, শিক্ষার মান বাড়েনি। কারণ শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান চলছে না। উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। কারণ একবার বাড়ছে তো আরেকবার কমছে। তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থায় মনোযোগ বাড়াতে হবে। ফল বাড়িয়ে বা কমিয়ে লাভ নেই। শিক্ষার মান ভালো হচ্ছে না। সেটা বাড়াতে হবে। তাহলে ফল এমনিতেই ভালো হবে।’

তবে এই ফলাফলকে বিপর্যয় বলতে নারাজ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, বিগত সময়ে যেভাবে পাসের হার বাড়ছিল, শিক্ষার্থীদের বেশি নম্বর দেওয়ার প্রবণতা ছিল, এবার ঢালাওভাবে পরীক্ষার্থীদের পাস করানোর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় লাগাম টেনেছে। এটি ফলাফল বিপর্যয় নয়, বরং সরকারের একটা ভালো দিক। আগে ঢালাওভাবে পাস করলেও ভালো কোনো জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতেন। শিক্ষার মান রক্ষার জন্য বর্তমানে যে পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেটি একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা চলছে। শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। আগামীতে আরো পরিবর্তন আসবে।

তবে চলতি বছরও যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এবারের ফল সত্যের কাছাকাছি গেছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ করা উচিত বলে মত দেন এই শিক্ষাবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলেন, সরকার শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। সরকারের মতে, এসব কারণে পাসের হার কমেছে। তবে আমার মনে হয়, সরকার এসব পদ্ধতির ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না। আমার মতে, শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে যদি পাসের হার কমে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানটা প্রকৃতঅর্থেই বাড়াতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য তার উপযুক্ত শিক্ষা কাঠামো দরকার। কে কোন দিকে যেতে চান, সেদিকে যেতে দিতে হবে।

তবে এই ফল বিপর্যয় ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি না পাওয়ার পেছনে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সংকট আছে উল্লেখ করে এই শিক্ষা গবেষক জানান, শিক্ষকদের যোগ্যতার অভাব রয়েছে। শিক্ষক সংকট রয়েছে। সাবজেক্ট বাড়ছে, শিক্ষক বাড়ছে না। একজন শিক্ষককে অনেক বেশি বিষয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে প্রকৃত পাঠদান হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখা সেভাবে হচ্ছে না। শিক্ষকরাও এর জন্য দায়ী। ক্লাস না নিয়ে তারা কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু গোপনে অনেক ধরনের ফি দিতে গিয়ে অভিভাবকরা পড়ালেখা করাতে পারছেন না। স্কুল বাড়ছে, শিক্ষক বাড়ছে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, কাজে লাগছে না। সুতরাং সরকারকে শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হলে এসব দিকেও নজর দিতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এইচএসসির ফল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist