বিবিসি

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৮

তিস্তার উজানে সিকিমে বাঁধ, রুখে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয়রা

একদিকে সুউচ্চ কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঢাকা চূড়া, অন্যদিকে বইছে তিস্তার খরস্রোত। চারদিকে শান্ত সবুজের সমাহার। এটাই কাঞ্চনজঙ্ঘা রিজার্ভড বায়োস্ফিয়ার অঞ্চল। লেপচা উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত বাসস্থান। ওই বায়োস্ফিয়ারেরই একটা অঞ্চল জোংগু। সেখানকার নদীগুলোর ওপর চলছে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প। এসব প্রকল্প শান্ত সবুজ প্রাণময় পরিবেশের ওপর আঘাত হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা। সেখানেই হিগিয়াথাং গ্রামে বাস মায়াল্মিত লেপচার। তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ওই প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে। তিনি বলছিলেন, ‘এই কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এখান দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা, রঙ্গীত-এসব নদী হলো আমাদের প্রাণ। আমাদের কাছে অতি পবিত্র এই অঞ্চল।’

‘আমরা মনে করি কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ দিয়ে আমাদের শরীর তৈরি আর মৃত্যুর পরে এই নদী বেয়েই পূর্ব পুরুষদের কাছে পৌঁছিয়ে যায় আমাদের আত্মা,’ বলছিলেন মায়া। তার মতো হাজার চারেক লেপচা উপজাতির মানুষ ওই সংরক্ষিত এলাকায় থাকেন। বাকিরা সিকিমেরই অন্যান্য অঞ্চলে বা দার্জিলিং, নেপাল বা পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন। লেপচাদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় অন্য কেউ স্থায়ী বসতি গড়তে পারেন না-আইন এটাই। কেউ জমিও কিনতে পারেন না। তাদের সংরক্ষিত এলাকায়ই হাজির হয়েছে এক বিপদ; যার বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রতিবাদে নেমেছে লেপচার মানুষরা। তিস্তা আর রঙ্গীতের মতো নদীগুলোয় যেভাবে একের পর এক বাঁধ দেওয়া চলছে, তাতেই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে এই লেপচা জনজাতি।

মায়াল্মিতের কথায়, ‘এসব নদীই আমাদের প্রাণ, আমাদের জীবন। যেভাবে বাঁধ দেওয়া চলছে, তাতে নদী আটকিয়ে যাবে। এই পানি দিয়েই আমরা ধান চাষ করি, মাছ ধরি নদীতে, ফুল-ফলের বাগান করি। আমাদের তো জীবনটাই স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমাদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে।’

সিকিমে এখনো পর্যন্ত ২০টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। তার মধ্যে শুধু তিস্তার ওপরই ইতোমধ্যে চারটি প্রকল্প তৈরি হয়ে গেছে, আরো দুটি তৈরি হওয়ার অপেক্ষায়। সেই প্রকল্পেরই অন্তর্গত তিস্তা-৪ প্রকল্পটি, যা থেকে ৫২০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

লেপচা জনজাতিদের একটি সংগঠন এ বাঁধগুলোরই বিরোধিতা করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। জোংগুরই আরেকটি গ্রাম পাসিংডাঙ্গে থাকেন গিৎসো লেপচা। অনেক দিন ধরেই তিনি তিস্তা-৪ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়ছেন। কতগুলো বাঁধের জন্য তিস্তা প্রায় শুকিয়ে গেছে। আমাদের বলা হয় যে, এগুলো রান অব দ্য রিভার প্রকল্প। কিন্তু আসলে তারা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নদীর পানি নিয়ে যাচ্ছে।

‘ভূ-বিজ্ঞানিরা বারে বারে বলেছেন যে, হিমালয় সবচেয়ে কম বয়সী পর্বতমালার একটা। এখনো তৈরি হচ্ছে। যদি আপনি বর্ষার সময়ে আসেন, দেখতে পাবেন কত জায়গায় ভূমিধস হয়েছে। সেটা থেকেই বোঝা যায় যে, এই পাহাড় কতটা নাজুক। এ রকম একটা জায়গায় যদি বড় আকারের নির্মাণকাজ চালাতে থাকেন, তাহলে খুব স্বাভাবিক যে গোটা অঞ্চলে আরো বড় বিপদ নেমে আসবে,’ বলছিরেন গিৎসো লেপচা। ইতোমধ্যেই তিস্তাকে অনেক জায়গায় আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে, শেষ জলধারাটা বাঁচিয়ে রাখতেই আমরা লড়াই করছি, জানাচ্ছিলন লেপচা।

জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম, যারা তিস্তার ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি করছে, তারাও এই বিপদের সম্বন্ধে অবহিত। তাদের দাবি এর জন্য আগে থেকেই বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। নিগমের চেয়ারম্যান বলরাজ যোশীর কথায়, ‘লেপচা সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য আমরা প্রকল্পের জায়গাটাই বদল করে দিয়েছি। আর এটা রান অব দ্য রিভার প্রকল্প, তাই এর জন্য বড় জলাধার প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য নদীর জলপ্রবাহকে আটকিয়ে রাখা হয়, আর বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেই সেটা আবারও নদীতে ফেরত পাঠানো হয়।’

তবে যোশী এটাও স্বীকার করে নিলেন যে, আগে যেসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে তিস্তার ওপরে, তার ফলে সেসব জায়গায় নদী বেশ অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। উত্তর-পূর্ব ভারত নদীগুলোয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই গবেষণা করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কল্পবৃক্ষের সদস্য নীরজ বাঘোলিকর।

‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরই জলস্রোত আবারও নদীর প্রবাহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা ঠিক। কিন্তু তিস্তার ওপর এতগুলো বাঁধ তৈরি হয়েছে যে, কোনো না কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে জলপ্রবাহ বন্ধ থাকছেই। একটা প্রকল্প থেকে জল ছাড়ার পর অন্য প্রকল্পে আটকানো হচ্ছে। তাই গোটা নদীতেই তার প্রভাব পড়ছে,’ বলছিলেন বাঘোলিকর।

মায়াল্মিত আর গিৎসোদের কথায়, ‘আমরা কখনই উন্নয়নের বিরুদ্ধে নই। তবে যদি উন্নয়নই চান, তবে আমাদের ভালো রাস্তা, পরিবহন ব্যবস্থা-এসবের মতো বিষয়গুলোর সমাধান করুন আগে।’

তিস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে মায়াল্মিত বলছিলেন, ‘এখানকার সমাজের প্রত্যেকটা লোকই উন্নয়ন চায়। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না।’ পরিবেশবিদ ইসাক কিহিমকর বলেন, ‘আমরা এটা বুঝি যে সিকিমে জলবিদ্যুৎ তৈরির প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু নদীটা থেকে যদি শুধুই শুষে নেন সবকিছু, তা কী করে হয়! তিস্তার ওপরে একের পর এক বাঁধ তৈরি হয়েছে। আর কত বাঁধ দেবেন ওই একটা নদীতে?

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তিস্তা,সিকিম,কাঞ্চনজঙ্ঘা,তিস্তা বাঁধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist