হাসান জাবির

  ২৭ জুলাই, ২০১৭

কোথায় আরব কোথায় বসন্ত

২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায় জনগণ শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের ডাক দেয়। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া থেকে সূচিত এই গণবিক্ষোভ ক্রমেই প্রসারিত হয় অন্যান্য দেশে। মূলত উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের এই প্রতিরোধের নামই আরব বসন্ত। এ পর্যায়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে আরব স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার ভিত কেঁপে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই বসন্ত আরবদের চূড়ান্ত হতাশার কারণ হয়ে ওঠে। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বদলে আরব বসন্ত থেকে সৃষ্ট আঞ্চলিক নৈরাজ্য হতভাগা আরব জনগণের জীবনকে যুদ্ধের বিভীষিকার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তরুণ কম্পিউটার প্রকৌশলী বউকুজিজি। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে চাহিদামতো চাকরি না পেয়ে তীব্র হতাশায় ভুগছিলেন। প্রত্যাশিত চাকরি না পেয়ে ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে প্রকাশ্যে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে হত্যা করেন। তার এই ব্যতিক্রম প্রতিবাদ, সর্বোচ্চ ত্যাগ তিউনিসিয়ার তরুণ প্রজন্মকে উত্তাল করে তোলে। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয় গণআন্দোলন। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে তিউনিসিয়ার সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তিউনিসিয়ার জনগণের এই সাফল্য সমগ্র অঞ্চলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে পর্যায়ক্রমে আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে আরববিশ্বের অগণতান্ত্রিক দেশসমূহে। আরব বসন্ত নামে এই গণআন্দোলন সহসাই বিস্ফোরিত হয় ইয়েমেন, মিসর, লিবিয়া এবং বাহরাইনে। গণপ্রতিরোধের মুখে ইয়েমেনের শাসক দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু তার আগে মিসরের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ছয় হাজার মানুষ হতাহত হয়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মিসরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের মুক্তির মধ্যদিয়ে মিসর বিপ্লবের ফল অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বাহরাইনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা সরকারের ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দেয় আরব বসন্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বাহরাইন সরকারের পতন প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে সৌদি আরব নিজের আদর্শিক মিত্র বাহরাইনকে রক্ষায় সেখানে সেন্য পাঠায়। বস্তুত সৌদি সেনা হস্তক্ষেপে বাহরাইনের রাজতান্ত্রিক সরকার আপাতত রেহাই পায়। কিন্তু বাহরাইনে গণঅসন্তোষ এখনো বিদ্যমান। যেকোনো মুহূর্তেই সেখানে আবারও গণবিস্ফোরণের আশঙ্কা আছে।

এরমধ্যেই আরব বসন্তের ঢেউ লাগে লিবিয়াতে। লিবিয়াতে আন্দোলন ছড়ায় ব্যতিক্রম পন্থায়। সম্পদশালী দেশ লিবিয়ার জনগণ কর্নেল গাদ্দাফির শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন না। দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার এই চিত্র আরব বসন্তের অন্তরালের কুশীলবদের জানা ছিল। যে কারণে মুষ্টিমেয় লিবিয়ান জনগণকে সশস্ত্র প্রক্রিয়ায় আন্দোলনে নিযুক্ত করা হয়। লিবিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে সামরিক উসকানির প্রকাশ্য প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে লিবিয়ায় বহু সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এই সশস্ত্র গ্রুপসমুহের এলোপাতাড়ি কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত লিবিয়াতে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপের পথ পরিষ্কার করে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে লিবিয়া আক্রমণ করে বসে ন্যাটো জোট। এর মধ্যদিয়ে গাদ্দাফির পতন ঘটলেও লিবীয় জনগণ কি মুক্তি পেয়েছে? খুব পরিষ্কারভাবে বলা যায়, লিবীয় জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি আরব বসন্ত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের অভিপ্রায় পূরণ হয়েছে ঠিকই।

জ্বালানিসমৃদ্ধ লিবিয়ার জাতীয় সম্পদে মার্কিন কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লিবিয়ায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংসের মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সমীকরণে মার্কিন আধিপত্য শক্তিশালী করেছে। লিবিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল আঞ্চলিক সামরিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন নিয়ে আসে। ফলে ভূ-মধ্যসাগরীয় এলাকায় মার্কিন সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের পথ প্রসারিত হয়। ভূমধ্যসাগরে অতিরিক্ত মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে বাস্তবসম্মত করে। এই প্রক্রিয়া কার্যত আরবদের অবশিষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থাও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়। যদিও পরবর্তীতে সিরিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক সামরিক সমীকরণে ভারসাম্য ফিরে আসে। অবশ্য এর আগেই আরব বসন্তের দাবানল সম্প্রসারিত হতে থাকে লেভান্ট অঞ্চলে। বহু ঘটনার ভেতর দিয়ে আরব স্প্রিং অবশেষে তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা খুঁজে নেয়। অর্থাৎ ২০১১ সালের মার্চেই আরব বসন্তে আক্রান্ত হয় মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি সিরিয়া। মজার বিষয় হচ্ছে সিরিয়াতেও প্রথমে অতি সামান্য সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। এ সময় সিরিয়ার বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সকল বিদ্রোহীদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও তুরস্ক। উপরোক্ত দেশসমূহ ছাড়াও কয়েকটি ইউরোপীয় এবং আঞ্চলিক দেশের প্রত্যক্ষ মদদে বিদ্রোহীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সিরীয় বিদ্রোহীদের ক্রমাগত সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে দেশটির সার্বভৌমত্বই প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই সেখানে আবির্ভূত হয় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।

ভয়ঙ্কর আইএসের বর্বরতা লেভান্ট অঞ্চলের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। ফলে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট হয় আরো ঘনীভূত হয়। পরিস্থিতির সুযোগে আইএস দমনের কথিত তৎপরতায় অংশ নেয় মার্কিন মিত্রজোট। একদিকে মার্কিন মিত্রজোটের বিমান হামলা অন্যদিকে বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে সিরীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ দ্রুতই শিথিল হয়ে পড়ে। যদিও দেশটির সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম করছে। অন্যদিকে কৌশলে সিরীয় সরকারি বাহিনীর শক্তির উৎস ভেঙে দিতে এখনো সচেষ্ট মার্কিন মিত্রজোট। সিরিয়া সঙ্কটের বহুমাত্রিক সমীকরণের ফল হিসেবে লেভান্ট অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের বিচরণ নির্বিঘ্ন হয়। ফলে সাধারণ জনজীবন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ পর্যায়ে বহু পরস্পর বিরোধী গ্রুপের সামরিক সক্রিয়তায় আসাদ সরকারের পতন প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে সিরিয়াকে রক্ষায় এগিয়ে আসে মিত্র রাশিয়া। রুশ সামরিক হস্তক্ষেপ সিরিয়া সরকারকে শক্তি জোগায়। রুশ সহায়তায় সিরিয়া নিজের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। এই বাস্তবতা কার্যত সিরিয়াবিষয়ক মার্কিন অভিসন্ধি তীব্র হোঁচট খায়। এর চেয়েও বড় সত্য হলো দামেস্ক কার্যত এখনো রক্তাক্ত, প্রতিদিন কোনো না কোনো পক্ষের মানুষ মারা যাচ্ছে। এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছে সিরীয় জনগণ। তখন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিবাসী সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে আরব বসন্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ওই অঞ্চলের শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়েছে আরব বসন্ত।

গণতন্ত্র, উন্নত নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে সংশ্লিষ্ট দেশের সামগ্রিক উন্নয়নই ছিল আরব বসন্তের মূল আবেদন। জীর্ণ, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের বিদায় করে অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার সুরক্ষার মাধ্যমে নিজ মাতৃভূমির মানুষদের জীবন ও ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু অন্তরালের কুশীলবদের নানামুুখী চক্রান্ত আরব জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাশার গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। কোথাও কোথাও পুরনো শাসকদের বিদায়ঘণ্টা নিশ্চিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসেনি কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক মুক্তি। তরুণদের কাজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু আইএস নামক ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠীর আবির্ভাব আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে সীমাহীন নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। এক সিরিয়া সঙ্কটেই প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের দায় সরকারবিরোধী সন্ত্রাসী, সিরীয় বাহিনী এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা কি এড়িয়ে যেতে পারবে? কিছুতেই না। এখানে ক্রিয়াশীল সব পক্ষই প্রকাশ্যে বা গোপনে যুদ্ধের কৌশলই আঁটছে হীনস্বার্থে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আরব বসন্ত কী দিল আরবদের? যে লক্ষ্যে আরব তরুণরা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল তারফল কী দাঁড়াল? এই প্রশ্নের উত্তর আছে শুধু আরব নেতৃত্বের কাছেই। এর উপযুক্ত উত্তর একদিন আদায়ও করবে আরব জনগণ। কিন্তু যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, আঞ্চলিক বিভাজন, সীমাহীন রক্তপাত ঘটল আরব বসন্তে তা কি পোষানো যাবে?

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরব বসন্ত,আন্তর্জাতিক,গণবিক্ষোভ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist