মো. কায়ছার আলী

  ১৮ জুন, ২০১৭

বাবা : পরম নির্ভরতার প্রতীক

দিল্লির সম্রাট বাবর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় মুঘল বংশের ভিত রচনা করেন। প্রাণপ্রিয় ছেলে হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল বাবা হিসেবে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। ছেলে হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। রাজ্যের সব বিজ্ঞ চিকিৎসক তাকে সারিয়ে তোলার কাজে সদা নিয়োজিত। কিন্তু এই অজ্ঞাত রোগ থেকে শাহজাদাকে ভালো করা যাচ্ছে না। শাহজাদার জীবন প্রদীপ ক্রমশ নিভে আসছে। বাবর হেকিমদের ডেকে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন এই রোগ হতে শাহজাদার মুক্তি সম্ভব কি না? সবাই নীরব নিস্তব্ধ। এই নীরবতা বাদশার বুকে শেল হয়ে বিঁধল। এমনি সময় জনৈক দরবেশ বললেন, সম্রাট যদি তার শ্রেষ্ঠ ধন মহান আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করতে পারেন তবেই আল্লাহর রহমতে শাহজাদার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে।

বেদনা বিধূর সম্রাট গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, তার সর্বশ্রেষ্ঠ ধন নিজের জীবন। তবু কোনো শঙ্কা নেই। তিনি আন্তরিকভাবেই চান তার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন বেঁচে থাক। তখন বাবর নিজ গৃহে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে নিজ জীবনের বিনিময়ে পুত্রের রোগমুক্তি কামনা করেন। আল্লাহ পাক তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং সেই দিন থেকে বাবরের রোগলক্ষণ দেখা দিল এবং হুমায়ুনের রোগ মুক্তি হলো। মহান পিতার মৃত্যুই ফিরিয়ে দিল পুত্রের আরোগ্য। বাৎসল্য বাবর এই মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। আসলে পিতা চিরকালই বৃক্ষ। আপন প্রাণরস দান করে ফল সতেজ রাখাই বৃক্ষের ধর্ম। পিতাও তাই প্রাণরস দান করে সতেজ রাখেন পুত্রকে। আর এভাবেই জন্মদাতা, পিতা বা বাবাদের ভালোবাসা, আদর, সোহাগ, সন্তানের প্রতি অক্টোপাসের মতোই মায়ার জালে বন্দি হয়ে আছে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। থাকবে ধ্বংসের শেষ দিন পর্যন্ত।

আজ রোববার ১৮ জুন, বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতিবছরের জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় বাবা দিবস। ১৯১০ সালে আমেরিকার সেনোরা লুইসের একান্ত প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো বিশেষ এই দিনটি উদযাপিত হয়। সেনোরা ছিলেন ছয় ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা ইলেন স্মার্ট যখন মারা যান তখন সেনোরার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নেন। সারাক্ষণ তিনি তাদের দেখেশুনে রাখতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও স্মার্ট তাদের মায়ের অভাব এতটুকু বুঝতে দেননি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্থায়ীভাবে বাবা দিবসকে রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। ১৯৭৪ সালে সেনোরা স্মার্টকে তার অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও আজ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বিভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালিত হলেও আজ ৮৭টি দেশ বিশ্ব বাবা দিবস পালন করছে। এই পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে, যা কল্পনার অতীত বা চিন্তার বাইরে।

প্রাচীন ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী (যেহেতু তিনিও একজন মহান বাবা) তার মেয়ের সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য গজনীর সুলতান মাহমুদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার শর্তে পৃথিবীর অন্যতম মহাকাব্য শাহনামা রচনা করেন। শাহনামা রচনায় কবি কঠোর পরিশ্রম করেন, যা ৭টি বৃহৎ খণ্ডে ৬০ হাজার শ্লোকে সমৃদ্ধ ছিল। আর এটি রচনায় সময় লেগেছিল ৩০ বছর। মহাকাব্য গ্রন্থটি প্রাচীন ইরানের রাজা-বাদশাহ ও বীর পুরুষদের কাহিনি নিয়ে রচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের কুবুদ্ধিতে সুলতান মাহমুদ ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা মতান্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্ষোভে, ক্রোধে ও দুঃখে কবি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে অনেক দেরিতে সুলতান নিজ ভুল বুঝতে পেরে প্রাপ্য ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দূত মারফত কবির বাড়িতে প্রেরণ করে জানতে পারেন যে, কবি আর পৃথিবীতে নেই। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবির মেয়ে সেই স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করেননি।

সেই মহাকাব্যের গৌরবগাথা সোহরাব-রোস্তম অর্থাৎ পিতা-পুত্রের অমর কাহিনি আজ বিশ্বে প্রচারিত। প্রাচীন ইরানের জাতীয় বীরযোদ্ধা মহাবীর রোস্তম তার অতুলনীয় শক্তি ও সাহসের জন্য পৃথিবীর মানুষের কাছে কিংবদন্তির মহানায়ক। মহাবীর রোস্তম যেমন একজন জাতীয় বীর তারই পুত্র সোহরাব নিজের পিতার যোগ্য উত্তরাধিকারী। মহাবীর রোস্তমের জীবন অত্যন্ত করুণ এবং মর্মন্তুদ। কৌশলে বীরত্বের রীতির কথা বলে পরের দিন নিজেই সুযোগ বুঝে তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার তলোয়ার বের করে সোহরাবের বুকে ঢুকিয়ে দেন। সোহরাবের বুকের তাজা রক্তের সঙ্গে সঙ্গে বের হতে থাকে প্রকৃত পরিচয়। ধীরে ধীরে সোহরাবের নিষ্পন্দ দেহ পিতার বক্ষে আশ্রয় লাভ করে। তখন নির্জন গিরিপথে কোনো প্রাণী ছিল না। আকাশের সূর্য এসে সোহরাবের মুখে পড়েনি। কোনো বিদায় রাগিণী বেজে উঠে সেই বিদায় দৃশ্যকে বিহ্বল করেনি। তখন রোস্তমের বুক ফাটা হাহাকার আর কান্না পাহাড়ে ধাক্কা লেগে এক বেদনা বিধূর বিলাপ তৈরি করেছিল : সোহরাব ফিরে আয় বাবা, ফিরে আয় সোনামানিক, কথা বল বাবা, বাবা বলে একবার ডাক। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে বারবার বলছিল নেই সোহরাব নেই। দিবসের শেষ সূর্য যখন পর্বতের ওপারে ঢলে পড়ল, তখনো হতভাগ্য মহাবীর রোস্তম ছেলের প্রাণহীন দেহ বক্ষে ধারণ করে বারবার বলছে : আয় সোহরাব ফিরে আয়। মহাবীর রোস্তম বীর হিসেবে যুদ্ধে একবার জিতেছেন কিন্তু পিতা হিসেবে চিরতরে হেরে গেছেন।

বাবা দিবস সম্পর্কে লিখতে গেলেই মনে পড়ে কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের কথা। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’-এ তিন ডব্লিউ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে লস এঞ্জেলেস গিয়েছি। হোটেলে ওঠার সামর্থ্য নেই। বন্ধুর বাসায় উঠে রাতে ক্যাম্পিং করতে জঙ্গলে গিয়েছি। গভীর রাতে দ্বিতীয়া মেয়ে ১২-১৩ বছরের শীলার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। দেখি শীলা বসে আছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা কী হয়েছে? শীলা বলল, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমি সারারাত তার পাশে থাকার কথা বলি, তখন শীলা একপর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাল। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে শীলা বলে, বাবা তুমি একজন ভালো মানুষ। আমি বললাম, ‘মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।’

মুঘল সম্রাট শাহজাহান এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’। হৃদয়ের অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ বাবা এবং সন্তান। তাই সন্তানের চোখ দিয়ে পানি পড়লে বাবাদের চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে। সন্তান অসুস্থ হলে বাবাদের হৃদয় পুড়ে যায়। কষ্ট পেলে মনে বা অন্তরে ঘা হয়, ব্যথা পেলে বেদনার ছাপ তাদের চোখে মুখে আপ্লুত হয়। বাবাদের ভালোবাসা বর্ষায় নদীর উপচে পড়া ঢেউয়ের মতো, ঝর্ণার ঝরঝর ধারার মতো, সকালের সোনাঝরা রোদের মতো আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দের মতো!! সেই বাবাকে সন্তানরা যখন অবহেলা করে, তখন? ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার অমর আকুতি, বেদনা, মিনতি ও আক্ষেপ ভরা ওই কালজয়ী গানটির পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে শিল্পীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কোরাসে গাইতে- ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার,/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।/নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি,/সবচাইতে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি।/ছেলের আমার- আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম-/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সম্পর্ক,বাবা দিবস,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist