reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৬ মার্চ, ২০২০

কতটা নিরাপদ হোম কোয়ারেন্টাইন?

সারা বিশ্বে মহামারীর রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের দেশে সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশ ফেরতদের বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশনা সরকার দিলেও উদ্দেশ্য পূরণে তা কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এই কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম উদাহরণ দিয়ে বলছেন, একটা বালতিতে রাখা মাছের বাচ্চাকে আপনি ধরতে পারবেন। কিন্তু বালতি থেকে যখন তাদের পুকুরে ছেড়ে দেবেন, তখন তাদেরকে আর ধরা যাবে না।

হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের আপত্তির পর তাদের ছেড়ে দেওয়া নিয়ে একথা বলেন বিএসএমএমইউর সাবেক এই উপাচার্য।

আড়াই মাস আগে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ওই শহর থেকে আসা বাংলাদেশিদের ঢাকার আশকোনার হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর তাদের ১৪ দিন পর ছাড়া হয়েছিল।

চীন থেকে দ্রুতই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস; কভিড-১৯ রোগীর সন্ধান মিলতে থাকে ইউরোপেও।

কিন্তু চীনের উহান থেকে আসা বাংলাদেশিদের পর আর কাউকে সরকারিভাবে কোয়ারেন্টাইনে না রেখে তাদের বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়। তার মধ্যেই ইতালি থেকে আসা দুজনের মধ্যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ধরা পড়ে, তাদের একজনের স্বজনের দেহেও তা ছড়ায়।

এরপরও ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনের পরামর্শই দিয়ে যাচ্ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। আর উপসর্গ কারও মধ্যে দেখলে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছিল।

যাদের মধ্যে রোগের লক্ষণ রয়েছে, তাদের হাসপাতালে আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসা দেওয়াটাই আইসোলেশন। আর যাদের মধ্যে কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু তারা আক্রান্ত এলাকা থেকে এসেছেন কিংবা কোনো কভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের নিজেদের আলাদা রাখার প্রক্রিয়াটি হল কোয়ারেন্টাইন।

আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২ হাজার ৩১৪ জন বিদেশফেরত হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। হাসপাতালে ‘আইসোলশনে’ আছেন ১০ জন।

গত ২১ জানুয়ারি থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ৬ লাখ ৬ হাজার ১২ জন বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হলেও অনেকই ঘরের বাইরে যাচ্ছেন, ঘুরছেন, যা আতঙ্কিত করছে অন্যদের।

নরসিংদীর পলাশ উপজেলার একটি গ্রামে সম্প্রতি কয়েকজন ইতালি থেকে ফিরেছেন। একজন এসেছেন এক সপ্তাহ আগে। তারা এলাকায় ঘোরাফেরা করায় আশপাশের মানুষের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে।

ওই গ্রামের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা বাজারে যাচ্ছে, চায়ের দোকানে আড্ডা মারছে। তারা আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন। এ কারণে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও চক্ষুলজ্জায় কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু সবার মধ্যেই একটা অস্বস্তি-আতঙ্ক কাজ করছে। হয়তো তারা এই রোগের জীবাণু বহন করছেন না, তারপরও সতকর্তা হিসেবে বাড়িতে অবস্থান উচিৎ ছিল।

আরও বিভিন্ন জেলায় বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের অবাধ বিচরণের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল বলেন, বিদেশ ফেরতরা যদি হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমরা যাদের বাড়িতে থাকতে বলছি, তারা সেটা ঠিকভাবে পালন করতে পারছে কি না?

এই অসচেনতার কারণে রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই ভাইরোলজিস্ট। আবার বাংলাদেশের বাড়িগুলোতে কোয়ারেন্টাইন সফল হবে কি না, তা নিয়ে তার ঘোর সংশয় রয়েছে।

তিনি বলেন, বাসায় কোয়ারেন্টাইনের সময় কেউ না কেউ তাকে সেবা-শুশ্রূষা করছে। যারা এ কাজটা করছে তারা তো প্রশিক্ষিত না, বাসারই লোক। তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণও নেই। সেবাদানকারী পার্সোনাল প্রকেটশন না নিলে তারাও ইনফেক্টেড হয়ে যেতে পারে।

একারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট স্থানে কোয়ারেন্টিন করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক নজরুল। তার মতে, হাসপাতাল ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল-কলেজ খালি করে সেখানে লোকজনকে রাখা যেতে পারে।

উহান থেকে বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ে লাখের বেশি মানুষকে আক্রান্ত এবং ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর পর কভিড-১৯ রোগকে মহামারী ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এরপর ভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত দেশ ইতালি থেকে শতাধিক বাংলাদেশি শনিবার ফেরার পর তাদেরও আশকোনার হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে থাকতে তাদের অনীহা ও ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে তাদের প্রাথমিক পরীক্ষা করে বাড়ি ফিরতে অনুমতি দেওয়া হয়; যদিও তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেনও। তিনি বলছেন, দেশবাসী কোটি কোটি মানুষের স্বার্থে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া উচিৎ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে ইউরোপের ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশ ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে একবার বাইরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ, কেননা এখানে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতাও অনেক কম।

এদিকে গাজীপুরে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে ইতালি ফেরত যাদের রাখা হয়েছিল, তারাও সেখানে থাকতে চান না। রোববার তারা বিক্ষোভের এক পর্যায়ে হাসপাতালের তালা ভেঙে ফেললে পুলিশ ডাকতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে হোম কোয়ারেন্টিনে যারা রয়েছেন, তাদের বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করতে কঠোর হওয়ার আভাস দিয়েছে সরকার। আইন প্রয়োগের হুমকি আইইডিসিআর দেওয়ার পর মানিকগঞ্জে একজনকে সাজাও দেওয়া হয়েছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ইতালি ফেরত যারা বাড়ি ফিরে গেছেন, তাদের উপর ‘কঠোর’ নজর রাখছেন তারা। তাদের পাসপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে। তারা যখন যাচ্ছেন, তাদের আশপাশে পুলিশ সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করছেন।এলাকায় গিয়ে পৌঁছালে আমাদের যে কমিটি আছে, সে কমিটি সার্বিকভাবে মনিটর করবে।

কোয়ারেন্টাইনে রাখার যুক্তি দেখিয়ে আইইডিসিআর বলছে, তারা সুস্থ অবস্থায় করা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ মুক্ত প্রমাণিত হলেও এরপর যে কোনো সময় সে দেশে থাকাকালীন বা বিমানে-ট্রানজিটে অবস্থানকালে ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। হয়ত এখনও লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, কিন্তু ভাইরাসের সুপ্তিকালের ১৪ দিনের মধ্যে তিনি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এ কারণে দেশে ফেরার পর মোট ১৪ দিন পর্যন্ত তিনি অন্যান্য সুস্থ্ ব্যক্তি থেকে দূরে থাকবেন।

এরপরও কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনে না থাকলে ‘হার্ডলাইনে’ যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন আইইডিসিআর পরিচালক।

বিষয়টি গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, এ ধরনের পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণে জনগণ যদি অংশগ্রহণ না করে তাহলে তা মোকাবেলা করা কঠিন। এ কারণেই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিষয়টি তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইনি। এ কারণেই হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টি বলেছি। এরপরও যদি তারা কথা না শোনেন, আমরা হার্ডলাইনে যাইনি। এরপর হয়ত আমাদের হার্ডলাইনে যেতে হবে। আইন ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে অবস্থান করাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র : বিডিনিউজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হোম কোয়ারেন্টাইন,নিরাপদ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close