ফয়সাল বিন লতিফ
মুক্তমত
টেকসই উন্নয়নে ‘থ্রি-জিরো’ মডেলের ভূমিকা
‘থ্রি-জিরো থিউরি’ আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরি এবং পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি মডেল। এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেগুলো হচ্ছে- জিরো দারিদ্র্য, জিরো বেকারত্ব ও জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ। আর তা অর্জনে প্রয়োজন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বজুড়ে আলোচিত তার এই থ্রি-জিরো তত্ত্বের জন্য। টেকসই উন্নয়নের এই তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমেই তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে এগিয়ে নিতে চাইবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াও বিশ্বেরই চোখ টেকসই উন্নয়নে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে সামনে থাকছে তার নিজের তত্ত্ব থ্রি-জিরো। এ ক্ষেত্রে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ। এই তত্ত্বের ব্যাপারে ড. ইউনূসের ভাষ্য, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এই ব্যবস্থার অধীনে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্র্য তৈরি করে না, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয় দারিদ্র্য।’ এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসায়। তার মতে, ভালো চাকরি না খোঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য, কারো অধীনে চাকরি করার জন্য নয়। তাই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারো অধীনে নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ‘থ্রি- জিরো থিউরি’ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বদ্ধপরিকর। এবারের এসডিজি-১৭ মূল লক্ষ্য হচ্ছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারত্ব উজ্জীবিত করা ও বাস্তবায়নের উপায়গুলো শক্তিশালী করবে। টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে ‘থ্রি জিরো থিউরি’ অনুঘটন হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার লক্ষ্যে একটি পরিপত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে ‘থ্রি-জিরো থিউরি’ কে কার্যকরের রূপরেখা বাস্তবায়িত হবে আশা রাখি।
ড. ইউনূসের মতে, সমাজের উন্নয়ন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে পরিবেশকে ধ্বংস না করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি বাসযোগ্য স্থানে পরিণত হয়। তাই পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের শুধু তিনটি শূন্য অর্জন করতে হবে। এ জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, মসজিদ থেকে মন্দির সর্বস্তরে সভা সেমিনারের মাধ্যমে এই থিউরিটাকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যর মাধ্যমে সচেতনতা করতে হবে। থ্রি-জিরো থিউরির মাধ্যমে এমন একটি টেকসই উন্নয়ন করতে হবে, যার মাধ্যমে এমন একটি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে, যার ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা পায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) ও মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রহণ করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশের উচিত ‘থ্রি-জিরো থিউরির’ সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সব সূচকে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। আধুনিক চ্যালেঞ্জের মুখে, কৃষিক্ষেত্রে টেকসই ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ কৃষি ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের থ্রি জিরো তত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশ তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রাখে। এই মডেলের মাধ্যমে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চলতে পারে। এভাবে, এই মডেলটির সমন্বয়ে দেশ সার্বিক উন্নয়নে একটি নতুন পথ তৈরি করবে এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ড. ইউনূস একটি সমতাভিত্তিক ও স্থিতিশীল পৃথিবীর ধারণা তুলে ধরেছেন, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা একসঙ্গে চলবে।
আমরা যদি সত্যি সত্যিই এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চাই, আগামী প্রজন্মের জন্য এ গ্রহকে নিরাপদে রেখে যেতে চাই, তাহলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘তিন শূন্য’ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক পিএলসি, পটুয়াখালী
"