আরিফ মঈনুদ্দীন
উপন্যাস (পর্ব ৩৭)
তাহারা ফিরিয়া আসিলেন
স্যারের এমন আন্তরিক আবদারপূর্ণ সম্মানজনক কথায় শফিক শরমে মরে যাচ্ছেন। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে- অনেক দিন যোগাযোগ না করার জন্য। তিনি লজ্জিত কণ্ঠে বিনয় প্রকাশ করে বললেন, স্যার আমি আগামী মাসে দেশে আসছি। একেবারে সরাসরি বাড়ি আসব আগে। আপনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।
ঠিক আছে, আলাপ করা যাবে। তোমার মেয়েটা কেমন আছে? কত বড় হয়েছে সে?
ও তো কলেজে পড়ছে স্যার। ভালো আছে। দেখতে মাশাআল্লাহ বেশ সুন্দর হয়েছে! ইনশাআল্লাহ আগামী মাসে দেখা হবে।
তোমার বউ কেমন আছে। আমার সালাম দিও।
জি স্যার, ভালো আছে। আপনাদের পরিবারের সবাই ভালো আছে তো? শুনেছি, আপনার ছেলে আজাহার নাকি স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছে। বড় ভাই বলেছে। খুব ভালো নাকি চালাচ্ছে। আমিও ভাবছি। আপনারই তো ছেলে। ভালো না হয়ে উপায় আছে।
তাহের উদ্দিন বললেন, সবাই তো বলছে ভালো। আমিও দেখছি। মনে রাখিও একটি জায়গায় সবাই হারতে চায়। তেমন আমিও চাই ও আমাকে ছাড়িয়ে যাক। আমি ওর কাছে হারলেই নিজেকে বিজয়ী ভাবব। আমি চাই আমাদের প্রতিষ্ঠিত আমার এই প্রাণের প্রতিষ্ঠান দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি স্কুল হিসেবে এই এলাকার মুখ আরো উজ্জ্বল করুক।
অবশ্যই স্যার, আমারও চাওয়া আপনার মতোই। আপনার আশা পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রফেসর শফিক সাহেব অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা টাকা এবং নিজের জন্য অন্যান্য জমানো টাকা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী রেখে বাকিটা দেশে সোনালী ব্যাংকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি ফুরফুরে মেজাজে আছেন। ঘরের পরিবেশ এখন বেশ ভালো। কারো সঙ্গে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কোনো দ্বিরুক্তি নেই। এক রকম ঝামেলাহীনভাবে তিনি এই দেশ ত্যাগ করতে চান। প্রথম প্রথম ভেবেছিলেন কীভাবে এদের মা-মেয়েকে বাগে আনবেন? অন্তত বাড়ি যাওয়ার বিষয়ে রাজি করাতেই তো তার বারোটা বেজে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল। তার ওসব ঝামেলার ধারেকাছেও যেতে হলো না। অবস্থা তার অনুকূল হওয়াতে শুরুটাই ঝলমলে হয়ে উঠল। এই অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের সবাই তো কমবেশি পরিচিত। সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং সম্পর্ক আজিম সাহেবের সঙ্গে। তিনি তো প্রথম থেকেই বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে একমত। কিন্তু এই বছর সেই বছর করে করে এ পর্যন্ত এলেন। এখনো তার ফেরা হলো না। আজিম সাহেবকে দেশে বেড়াতে যাওয়ার কথাই শুধু বলা যাবে। বাকি পরিকল্পনার কথা এখন নয়, প্রয়োজনে দেশ থেকে ফোন করে বলা যাবে। লোকটির সঙ্গে শফিকের ভালো ভাব ছিল। কিন্তু মেয়েটির উল্টাপাল্টা চলাফেরার কারণে কখন থেকে যেন সেই আজিম সাহেবও শফিককে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিল। তা-ই মনে মনে ভাবছেন...। এখন তিনিই তো আগে যাচ্ছেন দেশে। এই কথাটা যদি আজিম সাহেবকে বলা যেত- ভালো লাগত। কিন্তু কৌশলগত কারণে এখন তা সম্ভব না।
শিউলি টেলিফোনসেটটা হাতে নিয়ে ভাবছে। রাত প্রায় ১টা। মাইকেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। দেশে যাওয়ার কথা তার সঙ্গে আলাপ করেছে সে। মাইকেল বলেছিল, তা ঠিক আছে যাও। কিছুদিন থেকে-টেকে রিফ্রেশ হয়ে এসো। এমনভাবে বলল যে সে, শিউলি কিছুটা আহত হয়েছে। বাংলা উপন্যাস-গল্পে নায়িকার প্রস্থানোদ্যত সময় হঠাৎ নায়ককে যেভাবে হতাশ নিরুদ্যম বা ম্রিয়মাণ করে তোলে সে-রকম কিছু মাইকেলের ভেতর শিউলি লক্ষ করেনি। শিউলি একটি বিষয় লক্ষ করেছে প্রায়ই। মাইকেলের সঙ্গে শিউলির যখন দেখা হয়, মাইকেল শিউলির শরীরের প্রতিই বেশি আগ্রহী অথবা আকৃষ্ট হয়। প্রেম-ভালোবাসার চর্চায় তার মনোযোগ তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। শিউলি ভাবে- এই ভাবনাটা হয়তো তার বেশি বেশি গল্প-উপন্যাস পড়ার ফল। তারপরও শিউলি তার কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছার হাতিয়ার হিসেবে মাইকেলকে ভরসা ধরে রেখে এসবকে উপেক্ষা করে। সে যাই হোক। আগামীকাল তাদের দেশে যাওয়ার ফ্লাইট। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। মাইকেলকে তো জানাতে হবে। সে ফোন দিল।
ওপাশ থেকে মাইকেল বলল, হ্যালো ডার্লিং ইভা বলো- কেমন আছো? তুমি যাচ্ছো কবে?
শিউলি বলল, হ্যাঁ সেজন্যই তো ফোন দিয়েছি। আমরা আগামীকাল যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো। দেশে গিয়ে ফোন করব।
আচ্ছা তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমার ফোনের শব্দে জেগেছি। চোখে ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি। এই উঠে বসলাম এখন বলো, তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?
শিউলি বলল, তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো, আজ আর কথা বলব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমিও একটু রেস্ট নাও। নিশ্চয় গোছগাছ করতে করতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা গেছে।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ। ২৮ অক্টোবর প্রফেসর শফিক সাহেব পরিবার নিয়ে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। নিজের দেশে আরো তো কতবার এভাবে বিমান থেকে নেমেছেন। কিন্তু আজকের অবতরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অর্থবহন করে নিয়ে এসেছে তার কাছে। একটা বিজয়সূচক ভাবনা মনে মনে গুনগুনিয়ে গান তুলে দিয়েছে। সময়টা বিকেল। বিমানবন্দরের যাবতীয় ফরমালিটি সেরে তিনি রেন্ট এ-কার থেকে একটি টিপটপ মাইক্রোবাস ভাড়া করলেন। নোয়াখালী যাবেন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সুন্দলপুর গ্রাম। একেবারে সরাসরি নিজের গ্রামের বাড়ি। রাস্তাঘাট ভালো। ইনশাআল্লাহ কোনো ঝক্কি-ঝামেলা হবে না।
গাড়িতে মালপত্র তোলা হয়েছে। শিউলি বাবা-মার পেছনের সিটে একা বসেছে। সে ইচ্ছামতো শুয়ে-বসে আরাম করে যাবে। ড্রাইভারের পাশের আসনে হেড-সাফোর্ট পিলোটা খুলে ফেলেছেন শফিক। সম্মুখের রাস্তায় দৃষ্টিটা যেন বাধাপ্রাপ্ত না হয়। বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাস্তা। দেখতে দেখতে যাওয়া। ইয়াং ড্রাইভারকে বেশ তেজি মনে হচ্ছে। মোটামুটি সপ্রতিভ ছেলে। সুন্দর কথা বলে। আদবকায়দায়ও ভালো, এরা রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভার। কথাবার্তায় ভালো না হলে তো চলে না। এটা তাদের পার্ট অব দি জব। ড্রাইভার বলল, স্যার আরাম করে বসেন। এই রাস্তাটা ভালো গাড়ি চালাইয়া আরাম।
গাড়ি বিমানবন্দর এলাকা থেকে বের হলো। কুড়িল ফ্লাইওভার হয়ে ৩০০ ফিট রাস্তায় নেমেছে। পূর্বাচল উপশহরের প্রধান সড়ক এটি। বারলেনের রাস্তা। বেশ চমৎকার। শফিক সাহেব ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম যেন কী বললে?
জি স্যার, আমার নাম মোহাম্মদ শরীফ হোসেন।
তা নাম তো তোমার বেশ। কাজে-কামেও নিশ্চয় নামের মতোই হবে।
জি স্যার দোয়া করবেন। এই লাইনে আমাদের বেশির ভাগ সহকর্মী একটু এদিক-সেদিক বেপরোয়া চলে- বদনাম আছে। তবে আমরা কয়েকজন আছি- ভালো। ভালো কাজ করি। ভালো চিন্তা করি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি বেশ ভালো আছি। এই মাইক্রোবাসটি আমার নিজের। রেন্ট-এ-কার কোম্পানির মাধ্যমে চালাই।
শফিক সাহেব বললেন, কেন তুমি নিজে নিজে চালালেই তো বেশি টাকা আয় করতে পারো। রেন্ট-এ-কার কোম্পানি তো তোমার কাছ থেকে কমিশন নিয়ে যায়। তাই না?
শফিক বলল, কমিশন নিক। সমস্যা নাই। কিন্তু ট্রিপ পাওয়ার জন্য যে কষ্ট ওইটা করতে হয় না। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হইল, প্যাসেঞ্জাররা ভরসা পায় না- অনেক ড্রাইভারের সন্ত্রাসী হাইজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। ড্রাইভারের মাধ্যমে যাত্রীদের মালামাল টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে যায়। রেন্ট-এ-কার কোম্পানির মাধ্যমে গাড়ি নিলে এই ব্যাপারে ঝুঁকি থাকে না।
"