প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২১ জানুয়ারি, ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে জাপানের ভিন্ন অবস্থান কেন

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতিদ্রুত অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটি অনেকের কাছে বেশ অপ্রত্যাশিত ছিল। ভারত, চীন ও রাশিয়া দ্রুত অভিনন্দন জানাবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে পশ্চিমাদের পাশ কাটিয়ে জাপান যে অবস্থান নিয়েছে সেটি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে। এর কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই প্রশ্ন- জাপান কেন তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে ফুলেল অভিনন্দন জানালো? খবর বিবিসির।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচনের পর জাপান ছাড়া বাকিদের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এসব দেশের প্রতিক্রিয়া দেওয়া পর্যন্ত জাপান অপেক্ষা করেনি। অথচ বছর দেড়েক আগে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। নাওকি বলেছিলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে তিনি শুনেছেন। তার সেই বক্তব্য সরকারের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত দ্রুত জাপানের অবস্থান বদলে গেল কেন? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? বাংলাদেশ নিয়ে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গিও কি ভারত, রাশিয়া ও চীনের মতো হয়েছে? এসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, কূটনীতিতে সব দেশই নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

‘জাপান নিয়ে সবসময়ই একটু দ্বিধা থাকে। কারণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের প্রতিক্রিয়া মেলে না,’ বলছিলেন তৌহিদ হোসেন। রোহিঙ্গা সংকটের উদাহরণ টেনে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘তখন পশ্চিমারা যতটুকু ‘লিপ সার্ভিস’ দিয়েছে জাপান তাও দেয়নি। তারা কিন্তু বিনিয়োগ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে সামরিক শাসকদের পক্ষেই ছিল’। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা এখানে হয়েছে। বড় বড় প্রজেক্টগুলো যদি দেখেন এক্সপ্রেসওয়ে করেছে চাইনিজরা, মেট্রোরেল করেছে জাপানিরা, পদ্মা সেতু করেছে চাইনিজরা’।

‘লক্ষ্য করবেন, আমাদের যে প্রয়োজন আমাদের যে চাহিদা সেই প্রয়োজনের জোগান দেওয়ার মতো একটা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু আছে। চীনারা যখন এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, জাপান কিন্তু তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে সেখানে পিছিয়ে থাকতে চায়নি,’ যোগ করেন কবির।

তার মতে, জাপানকে পশ্চিমা জগতের সহযোগী হিসেবে না দেখে চীন এবং জাপানকে পাশাপাশি দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন জাপান পশ্চিমা জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব অবস্থান নিল।

‘প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের আলোকেই বাংলাদেশকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির অংশীদার হিসেবে চিন্তা করে। চীন-জাপান তার ব্যতিক্রম নয়। দুই দেশেরই দৃষ্টিভঙ্গিটা মূলত অর্থনীতি কেন্দ্রিক। কারণ তারা জানে এখানে বিনিয়োগের একটা বড় সুযোগ আছে। সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগাতে চায়।’

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষত দ্বিপক্ষীয় আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে জাপান বরাবরই সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে কয়েকশ কোটি ডলারের চীনা উদ্যোগ এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশের মতো বাংলাদেশেও চীনের উপস্থিতিকে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চীনের করা ওই উদ্যোগের বিকল্প দাঁড় করানোর একটা প্রচেষ্টা ভারত ও জাপানের মধ্যে লক্ষণীয়।

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে তিনশর বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে। দেশটির জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।

চীনের আধিপত্য ঠেকানো আয়োজন? কক্সবাজার উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে চীনে গিয়ে বন্দর নির্মাণে দেশটির সাহায্য চেয়েছিলেন। চীন বেশ আগ্রহের সঙ্গেই এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। স্থান নির্ধারণ করা হয় মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায়। কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারত সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এই পরিকল্পনা বাদ দিতে। তারা উল্টো প্রস্তাব দেয় সোনাদিয়া থেকে অল্প দূরত্বে মাতারবাড়ীতে জাপানের সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তই নেয়।’ বিবিসি বাংলাকে গত বছর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহমুদ আলী এই অভিমত তুলে ধরেন।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাংক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী অনু আনোয়ারও একই ধারণা ব্যক্ত করেছেন। জাপানি গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়াকে তিনি বলেছেন, সোনাদিয়ায় বন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা সফল হয়নি ভারতের বিরোধিতার কারণে।

কিন্তু চীন যা দিতে পারে সেটি দেওয়ার সক্ষমতা ভারতের নেই। সে কারণে জাপানকে স্বাগত জানিয়েছে তারা।

দেশটির অর্থায়নে সোনাদিয়ার অদূরে মহেশখালীরই মাতারবাড়ীতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। ‘এখন এই বন্দরে বাংলাদেশের যেমন লাভ হবে তেমনি ভারতেরও কম লাভ হবে না’, বলছিলেন আনোয়ার। তবে নয়াদিল্লির রিসার্চ অ্যান্ড ইফরমেশন সিস্টেমে ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের অধ্যাপক প্রবীর দে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক ‘অর্গানিক’। তৃতীয় কোনো দেশের এতে প্রভাব নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে। তবে দূর প্রাচ্যের দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্কের গভীরতা ভারতের বোঝাপড়ায়ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন তিনি।

বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের হিসাব-নিকাশের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচ্য দুই দেশের আঞ্চলিক অবস্থান দৃঢ় করার প্রবণতা দেখেন অধ্যাপক প্রবীর দে। তার ভাষায়, ‘এটা একটা ভালো প্রভাব বলয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের যে কৌশলগত অবস্থান ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তার গুরুত্ব অপরিসীম। এর সঙ্গে ভারত এবং জাপান যুক্ত হলে তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।’ এর ফলে শক্তিধর দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোনো কিছু আগের মতো চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন গবেষক প্রবীর। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও বৃহত্তর ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই অঞ্চলে তাদের নীতি প্রয়োগ করতে হবে’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত, চীন, জাপানের প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানানোর ক্ষেত্রে সাদৃশ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নির্বাচন ও নতুন সরকারের ব্যাপারে তাদের সবার অবস্থানই ইতিবাচক। প্রবীর দের মতে, অর্থনৈতিক দিক থেকে সরাসরি সম্পৃক্ততা, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য এই সম্পর্কগুলো ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক ক্রমশ গভীর করছে। তাই এর মধ্যে ‘চীন ঢুকে পড়লে কিছু নড়াচড়া হয়তো হবে কিন্তু সম্পর্কটা ভাঙবে না।’

অধ্যাপক প্রবীর যোগ করেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভারত এবং জাপান একে অপরের পরিপূরক। আবার ভূ-অর্থনীতিতে চীনের সঙ্গে দেশ দুটির বরং সহযোগিতার প্রবণতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছেন, দিল্লিতে মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানি প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের বিষয়টিকে। এসবের পরেও নিরাপত্তা ইস্যুতে কিছুটা দূরত্ব অবধারিতভাবে থেকেই যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close