দুই শিক্ষার্থীর সফলতার গল্প
তারা দুজনই শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি একজন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, অন্যজন ছবি আঁকেন। লেখালেখি, ছবি আঁকায় দুজনেই ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। দুই শিক্ষার্থীর সফলতার কথা জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
পৃথিবীর ২৪ দিনে ভিনগ্রহে একদিন
শিরোনাম দেখে একটু অবাক হওয়ারই কথা। আসলে এটি একটি বইয়ের গল্প। বইয়ের নাম ভিনগ্রহী। লিখেছেন লামিয়া হান্নান স্নেহা। ২২২ পৃষ্ঠা ৮৮০০০ শব্দের বইটি কাল্পনিক কাহিনির। এখানে লামিয়া এক ভিন্ন জগতের গল্প বলেছেন। এই জগতের একটি দিন হলো পৃথিবীর ২৪ দিনের সমান। শুধু কি তাই! এখানে যারা থাকে তাদের আছে একটি সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার। এই পাওয়ার দিয়ে তারা কত কিছুই না করে। ভিনগ্রহী মূলত অজানা জগতের একদল কিশোর-কিশোরীর যুদ্ধের গল্প। এমন এক জাতির গল্প, যারা মানুষের মতো আকৃতির হলেও দানবের মতো কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। যারা মানুষের অজান্তেই পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে যুক্ত।
লামিয়া ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় লিখেছে নাটক, যা স্কুলের প্রোগ্রামে মঞ্চস্থ হয়। লামিয়ার মাথায় নানা রকম ভাবনার উদয় হয়। এই ভাবনাগুলো জড়ো করেই একসময় বই লিখে ফেলে সে। ২০২১ সালে যখন তার ভিনগ্রহী লেখা শেষ, তখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়েন। বই তো বড় মানুষ লিখে। তবে লামিয়া এমন কী বই লিখল এতটুকুন বয়সে? যা ছোট বন্ধুদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। বড়রাও বইটিকে ভালোই বলেছেন। বইটি সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক জাফর ইকবাল বলেছেন, সুন্দর বই। ভেতরে কিছু লিখে দিয়েছ? অটোগ্রাফ আছে তো?
আমি মানুষকে অটোগ্রাফ দিই, কিন্তু এভাবে অটোগ্রাফসহ কেউ বই পাঠাবে ভাবিনি। থ্যাংকস স্নেহা। l will keep this.
স্কুলের আয়মান সাদিক বলেন, পড়াশোনার চাপ। এর মধ্যে লামিয়া এত বড় বই বের করল কীভাবে? পড়াশোনা গোল্লায় যায়নি তো? একদমই না। লামিয়া খুব পরিশ্রমী। একাই সব সামলে নিয়েছে সে। শোনা যাক তার মুখেই, বইয়ের পেছনে আমি অনেক সময় দিয়েছি, অনেক পরিশ্রম করেছি। বই লেখা শেষে বইয়ে ক্যারেক্টার ডিজাইন, illustration ডিজাইনের জন্য টিম তৈরি করেছি, প্রুফরাইট শেষে এডিটিং করেছি, adobeillustrator-এ বইয়ের এডিটিং করেছি, প্রকাশকদের খোঁজে ছোটাছুটি করেছি, পরিশেষে মানুষের সামনে তুলে আনতে অনলাইনে-অফলাইনে মানুষকে আমার বই সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। লামিয়া এখন আইডিয়াল কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন।
মজার বিষয় হলো, লামিয়ার বইয়ে কার্টুন এঁকেছে তারই ছোট ভাই রোহান। রোহান পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কার্টুন বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বড়রাই যেখানে বই প্রকাশে হিমসিম খায়। অনেকে তো নিজের টাকা দিয়েই নিজের বই ছাপে। লামিয়া তো ছোট মানুষ। তার বই ছাপতে কীভাবে রাজি হয়েছিল প্রকাশক? অনেকগুলো প্রকাশনী ঘুরে লামিয়ার হাঁসফাঁস অবস্থা। এত কষ্টের বই। ওমা, যেখানেই যায়, তারা ছাপার জন্য টাকা চেয়ে বসে। টাকার অংশ শুনে লামিয়ার তো ভিমড়ি খাওয়ার দশা। অবশ্য তখন সামান্য কিছু টাকা জমা ছিল তার কাছে।
এধার-ওধার ঘুরে শেষমেশ ঠাঁই হয় জ্ঞানকোষ প্রকাশনীতে। পাণ্ডুলিপি পড়ে জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর সিইও ওয়াসি তরফদার বলেন, বইটি ভালো লেগেছে, প্লট এবং সাজিয়ে তোলার প্রক্রিয়াটাও ভালো লেগেছে। তাই তিনি বইটি প্রকাশ করতে চান। খুশিতে লামিয়া সেদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। প্রকাশক তার টাকাই বই ছাপেন। উল্টো রয়্যালটি দেওয়ার কথাও বলেন।
লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে লামিয়া বলেন, শুধু সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি লিখে যাব এমন না। আরো অনেক অনেক পড়তে চাই। লেখালেখিকে শখ হিসেবে না প্যাসন হিসেবে নিয়েছি। তাই সিরিয়াসভাবেই কাজ শুরু করেছি এবং করছি। আমি বিশ্বাস করি যেসব কাজে সিরিয়াসনেস এবং আনন্দ নেই, সেই কাজগুলো মানুষকে সফলতা এনে দিতে পারে না। চেষ্টা চালাচ্ছি বিভিন্নভাবে নিজের লেখাকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করে নিজের একটা পরিচয় গড়তে। ভিনগ্রহী বইটির মূল্য ৩৫০ টাকা। অবশ্য লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিলে বাড়তি পাওয়া যাবে তার অটোগ্রাফ। ভিনগ্রহীর পর লামিয়ার লেখা অশরীরী, সুইসাইডাল মশা নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
সময় পেলেই ক্যানভাসে ডুব দেন সামিয়া
ছবি আঁকেন তিনি প্রায় এক যুগ। ক্লাস টুতে বসে প্রথম ছবি এঁকেছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা তার আয়ের উৎস। নিজের টুকটাক চাহিদা নিজের আয়েই মেটান। সফল এই আর্টিস্টের নাম সামিয়া ইসলাম। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাস প্রথম বর্ষে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট পড়াশোনা করেন। তার বাবা আমিনুল ইসলাম। একজন ব্যাংকার। মা, বাবা, ছোটবোন নিয়ে নোয়াখালীর মাইজদীতে থাকেন সামিয়া।
সামিয়ার ছবি আঁকার মাধ্যম হচ্ছে আ্যক্রেলিক, জলরং, গোয়াস রং। তবে পোস্টার রং, মামরং মাঝে মাঝে ব্যবহার করেন। ছবি আঁকা তার ভালোবাসা, শখ। এটা দিয়ে আয় করতে হবে। ব্যাপারটা তার কাছে একদতমই তা নয়। তিনি বলেন, মোটামুটি ছবি ভালোই বিক্রি হয়। আয়ের টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস, মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু কিনে উপহার দেওয়া, বন্ধুদের খাওয়ানো হয়। এ পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি ছবি সামিয়া এঁকেছেন বলে জানান। তার আঁকা ছবির ছবির সর্বনিম্ন দাম ২৫০ এবং সর্বোচ্চ এখন পর্যন্ত ২০০০।
মূলত প্রকৃতি হচ্ছে তার ছবি আঁকার মূল বিষয়। অবশ্য কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী ছবি আঁকেন তিনি। ইউটিউব চ্যানেল থেকে তিনি ছবি আঁকার অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানান। এ ছাড়া আর্টিস্ট খাদিজাতুল কুবরা, শুক্তির ভিডিও তাকে সহায়তা করেছে। তার আঁকা ছবির স্থায়িত্ব বেশ ভালোই। ফেসবুকে তার পেজের নাম Island of art। এখানে গিয়ে ছবির অর্ডার করা যাবে। তার আর্টগুলো দেখার সুযোগ আছে। শখের তো অন্য অনেক কাজ ছিল। ছবি আঁকা বেছে নেওয়ার কারণ কী? সামিয়া বলেন, ছবি আঁকাকে বেছে নিয়েছি কারণ ছবি আঁকাটা আমাকে যে মানসিক প্রশান্তি দেয় সেটা আর অন্য কোনো কিছু থেকে আমি পাই না।
পড়াশোনা এবং শৌখিন কাজ। দুটো একসঙ্গে চালিয়ে নিতে সমস্যা হয় না? সামিয়া বলেন, শখের কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ যখন পড়াশোনা করা হয় না তখনই আর্ট করি। আবার পড়াশোনার চাপ থাকলে আর্ট করা বন্ধ রাখি।
আর্র্ট করে আর্থিক লাভবান হওয়া সামিয়ার কাছে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজটা যেন সুন্দর হয়। শিল্পপ্রেমীদের মন জয় করে নেয়। সে কারণে তিনি অনেক ছোট ছবিও আঁকতেও ৪-৫ ঘণ্টা সময় নেন বলে জানান। বড় ছবি হলে ৪-৫ দিনও লেগে যায়।
সামিয়ার ঝুলিতে অনেকগুলো পুরস্কারও জুটেছে। তিনি বাংলা ভিশন ৫ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। বসন্ত উৎসব ১৪১৭ বঙ্গাব্দ চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান ছিল তার। নোয়াখালী অলরাউন্ডার ২০১৯-এ চিত্রাংকন বিভাগে এ ২য় রাউন্ডের জন্য ব্লু কার্ড পেয়েছিলেন তিনি। অনলাইন একটা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন তিনি। shilpo Bangla art exhibition ২০২২-এ ছিল তার আঁকা ছবি। কিছুদিনের মধ্যে S Talent art exhibition-এ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন বলে জানান। ছবি আঁকার পেছনে তার মা, বাবা, বন্ধুরা সমর্থন জুগিয়েছেন সব সময়। এমনটাই জানান তিনি। জানা গেছে, তিনি বাল্ব, গিটার, ফোন কভার, মাস্ক, ব্রাশদানি, ফেইস আর্ট, কাঠের গহনায় কিছু কাজ করেছেন।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও তার আর্ট পৌঁছে যাবে। বিদেশের বড় বড় exhibition-এ অংশগ্রহণ করবেন। পাশাপাশি খুলবেন ইউটিউব চ্যানেল। এগুলোই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ছবি আঁকায় আরো দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দেবেন বলে তিনি জানান।
"