রায়হান আবিদ

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

ফাতিহার চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশন

বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থার কোথায় যেন অলিখিতভাবে লেখা রয়েছে মাসিক বা ঋতুস্রাব নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা যাবে না! যদিও একজন কিশোরীর মনে মাসিক শব্দটি সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দগুলোর একটি। এ দেশের সমাজব্যবস্থায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের স্বল্পতা ও কুসংস্কারের কারণে বেশির ভাগ নারীকেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই শব্দটি উচ্চারণের জন্য লজ্জা পেতে হয়েছে। মাসিক শব্দটিকে সব সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থানে রাখার জন্য মাসিক বিষয়টি তাদের কাছে এখন অস্বস্তি এবং লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মাসিক মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং মর্যাদার।

ফাতিহার যখন এগারো বছর বয়স তখন তার প্রথম মাসিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। কিন্তু মাসিক বিষয়ে কোনো রকম ধারণা না থাকায় সে খুবই আতঙ্কিত হয় পড়ে। সে তার মাকে জানানোর পর মাসিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে। কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতা রয়েই গেল। মাসিক বিষয়টি সবাইকে অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থানে রাখার মানসিকতা ফাতিহার কাছে সামাজিক কোনো ব্যাধির মতো লাগত। সে এই সমস্যার অনুসন্ধানে জানতে পারে মাত্র ৫৩ শতাংশ কিশোরী মেয়েরা তাদের প্রথম পিরিয়ডের আগে মাসিকের কথা শুনেছিল, যেখানে ২০১৭ সালে প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশের মেয়েরা তাদের মাসিক চলাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। যার পেছনে মূল কারণ ছিল পর্যাপ্ত গুণগত স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা এবং স্যানিটারি প্যাড না থাকা। ফাতিহা বুঝতে পেরেছিল সঠিক MHM অর্থাৎ Menstrual Health Management এবং সাশ্রয়ী স্যানিটারি প্যাডের অভাবে এই সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এ সমস্যা সমাধানের সূত্রপাত ধরে, ২০২১ সালে চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করে। ফাতিহার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বা চ্যাপ্টার এটি। তাই ফাতিহা Chapter Her (চ্যাপ্টার হার) থেকে ChaptHer (চ্যাপ্টহার) ফাউন্ডেশনের নামকরণ করেন। সবাইকে MHM অর্থাৎ Menstrual health management সম্পর্কে অবগত করা এবং সমস্যাগ্রস্তদের কাছে সাশ্রয়ী স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি। তবে শুরুর দিকে চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশনের যাত্রাকালে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে ফতিহার। কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ফাতিহা তার চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ায়নি। এমন সময় তার বান্ধবী রাইসাও এই লক্ষ্যে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

ফাতিহার ChaptHer Foundation যাত্রা প্রকল্পের অংশ হিসেবে ফাতিহা ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করে। চলতি বছরের জুন মাসে চ্যাপ্টহার সফলভাবে দুটি মাসিক ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। এই ক্যাম্পেইনে প্রায় ৪০০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সারা দেশ থেকে ২০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। Period-talk সেশনগুলো মূলত তাদের দ্বারাই পরিচালনা করা হয়। এখানে তারা মাসিক বা ঋতুস্রাব-সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করে থাকেন। এর কিছুদিন পরই তারা জেসিআই ঢাকা নর্থ-এর সহযোগিতায় আরেকটি হেল্থকেয়ার ক্যাম্পেইন করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল মাসিকবিষয়ক সব সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষাসেবা প্রদান। এই ক্যাম্পেইনে তারা ন্যাশনাল বাংলা উচ্চবিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী এবং তাদের বাবা-মা মিলিয়ে প্রায় ১০০০ জনকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষাসেবা প্রদান করেছে।

চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশন শুধু ফিল্ড ওয়ার্কেই সীমাবদ্ধ নয়। পিরিয়ড জার্নি নামক এক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরম রয়েছে, যেখানে তারা কিশোরী মেয়েদের উৎসাহিত করে তাদের পিরিয়ড জার্নি সম্পর্কে বলত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আটজন এবং নেপাল, অ্যাঙ্গোলা, মাদাগাস্কার থেকে ৩ জন তাদের পিরিয়ড জার্নি বা গল্পটা চ্যাপ্টহারের সঙ্গে শেয়ার করেছে। তাদের এই ফাউন্ডেশন হার মুভমেন্ট নামের আরেকটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমের সূচনা করেছে। এই প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে তারা মাসিক নিয়ে সমাজে প্রচলিত সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং যারা মাসিককে লজ্জা, ঘৃণা বা খারাপ কোনো বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং যারা এ রকম পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়িয়েছে, তাদের গল্পও এখানে প্রকাশ করা হয়। কিছুদিন আগে তারা একজন ব্রিটিশ স্পোর্টসওম্যান Pallant-Browne-এর গল্প পাবলিশ করেছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ফাতিহা জানান, ভবিষ্যতে আমরা অতি স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করার পরিকল্পনা করেছি। বর্তমানে একটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের বাজারমূল্য ৭-৩০ টাকার আশপাশে। এখনো অনেক পরিবার স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করার সামর্থ্য রাখে না। এর ফলে সেসব পরিবারের মেয়েরা অস্বাস্থ্যকর কাপড় অথবা টিস্যু ব্যবহার করার কারণে তাদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। আমাদের উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনে কাঁচামাল হিসেবে আমরা আখের ছোবরা ব্যবহার করব। বর্তমান বাজারে যেসব স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায় অধিকাংশ ন্যাপকিনেই কাঁচামাল হিসেবে পলিআ্যক্রিলেট বেইস্ড সুপারঅ্যাবসরমেন্ট জেল ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এসব ন্যপকিন বায়োডিগ্রেডেবল না হওয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করেই আমরা রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি একটি সচেতন সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে চাই, যেখানে মাসিককে একটি সুস্থ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখা হবে এবং একটি মেয়েরও লেখাপড়া মাসিকের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

ফাতিহা তার চারপাশ থেকে শোনা কুসংস্কার থেকে বের হয়ে এসেছেন। এখন তার স্বপ্ন বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়েই যেন এসব প্রচলিত কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close