মৃণাল সরকার মিলু

  ০৭ নভেম্বর, ২০২৩

তাড়াশে প্রথম এসএসসি পাস নারী

আমাদের শিক্ষক অঞ্জলী রানী

শি-তে শিষ্টাচার, ক্ষ-তে ক্ষমাশীল, ক-তে কর্তব্যপরায়ণ আর এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে হন একজন আদর্শ শিক্ষক। প্রতিটি মানুষের শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে হয়। তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষক থাকেন, যাদের প্রতি সারাজীবন ছাত্রের শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আর ছাত্র যতই বয়সি হোক ওই শিক্ষকদের সালাম, কদমবুছি করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। মূলত একাল আর সেকালের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে সময়ের পক্রিমায় পার্থক্য এসেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংকল্প কবিতার দুটি চরণ না বলেই নয় তা হলো ‘বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ বর্তমানকালের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ, আইসিটি বিষয়ে অধিকতর পারদর্শী। তাদের শেখার ও জানার পরিধিটা এখন সহজতর ও সহজলভ্য অন্তত তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে। আর আগের দিনের শিক্ষকরা রাত জেগে কাজের ফাঁকে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতেন, যা পাঠদানকালে শিক্ষকরা অকাতরে শিক্ষর্থীদের আত্মস্থ করাতেন। এতে প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং করানো এসব বিষয় গৌণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এসব বিষয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর পড়ালেখার পার্থক্যটাও অনুমান করা যায়। তবে এ কথা ঠিক সেকালে পড়ালেখাটা শিক্ষকনির্ভর ছিল। তাই শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন।

মূলত শিক্ষকদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে ও এসব কারণে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও গভীর হয়। তাদেরই একজন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ। আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তখন তৃতীয় শ্রেণির পাঠকক্ষে পরিচয় হয় মাতৃতুল্য ওই শিক্ষকের সঙ্গে। বাংলা ক্লাসে আটপৌরে শাড়ি পরা কপালে সিঁদুর লাগানো হালকাণ্ডপাতলা গড়নের আমার প্রিয় শিক্ষকের প্রথম ডাক ছিল মানি (মানিক) দুষ্টুমি করোনা। আস্তে আস্তে তার পড়ানোর ধরন, বোঝানোর কৌশল ও তার কথাবার্তার শালিনতা, শব্দচয়ন আমাকে বিমোহিত করে। তিনি পাঠদানকালে সহজ উপায়ে যেভাবে পড়ার বিষয়গুলো উপস্থাপন করতেন তাতে একটা আর্ট বা শিল্প ছিল। তখন মনে হতো আমার শিক্ষক সব জানে। অবশ্য তখনো জানতাম না তিনি কত দূর লেখাপড়া করেছেন। অবশ্য পরে জানতে পারি তিনি ষাটের দশকে যখন নারীদের পড়ালেখা দুরুহ ছিল তখন তিনি একজন মেধাবী শিক্ষর্থী হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কিন্তু সে সময় শিশুবেলার সরলতায় বুঝতে পারতাম আমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক সবই জানেন। শুধু জানেনই না অনেক বেশি জানেন এই ধারণা আমার মনের ভেতরে গেঁথে যায় এবং আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়ে একটা গর্ববোধ কাজ করে, যা এখনো বুকের ভেতর লালন করি। তারপর ওই স্যারের সানিধ্য পেয়ে আমার দুষ্টামির মাত্রাটাও কমে যায়। সেই সঙ্গে আমার ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে আসে।

শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ এখন প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা। চোখে ভারী চশমা, পরনের শাড়িতে বোঝা যায় অনেক আগেই নানি-দাদি হয়েছেন। তবে আমার সৌভাগ্য হচ্ছে এই মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে পাই। তখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে তার পা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই পরম মমতায় এখনো আগের মতোই বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতে থাকেন। আর তার কাছে শেখা শিক্ষকের প্রতি সম্মানবোধটা আজও আমার চেনাজানা। সব শিক্ষকের প্রতি আমার সেই শ্রদ্ধাবোধ এই মধ্য বয়সেও আবেগে-আপ্লুত করে। অন্যদিকে শুধু ভাবতে থাকি, আমি আমার ১৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে স্যার অঞ্জলী রানী ঘোষের মতো তেমন কিছু কি অর্জন করতে পেরেছি? সেই পঞ্চম শ্রেণির কথা, প্রাথমিক স্তরে আমার হাতের লেখা খুব খারাপ ছিল, যা নিয়ে ওই সময়কার সহপাঠীরা আমাকে বেশ ক্ষেপাত। কিন্তু পরে আমার প্রিয় শিক্ষক অঞ্জলী রানী হাতের লেখা নিয়ে আমার মনঃকষ্টের বিষয়টি জানতে পারেন। তখন তিনি আমাকে সুন্দর হাতের লেখা শেখানোর জন্য কোন কোন বাংলা অক্ষর কতটুকু ছোট-বড় করে লিখতে হবে, কেমন করে হাতের লেখা সুন্দর করতে হয় তার কলাকৌশল তিনি ধৈর্যসহকারে অনেক সময় ধরে আমার হাত ধরে ধরে খাতার পাতায় লেখাতেন। যাই হোক, পরে আমার হাতের লেখা ভালো হতে থাকে, যা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত অক্ষুণ্ণœ ছিল। যার অবদান আমার ওই প্রিয় শিক্ষকের। তবে এখন আমার ওই শিক্ষকের ছেলের সঙ্গে বাজারে দেখা হয় মাঝেমধ্যে। তখন ওকে বলি ভাই কোথায় যাও? তখন ও বাজারের তালিকা দেখিয়ে বলত, মা বাজারের তালিকা করে দিয়েছেন, সেই তালিকা দেখে বাজার করছি ভাই। এ সময় ওই লেখা বাজারের তালিকা দেখে এখনো মনে হয় তার হাতের লেখা আগের মতোই আছে। আর ছাত্রজীবনে আমার বন্ধুরা আমার হস্তাক্ষর দেখে তখন প্রশংসা করত, সে কথা ভেবে এখনো আমি লজ্জা পাই। কেননা ৭০ বছরের অঞ্জলী রানীর এখনো যে সুন্দর হাতের লেখা সে তুলনায় আমার হাতের লেখা কিছুই না। আর শ্রেণিকক্ষে তিনি ছাত্রছাত্রীদের যেভাবে স্নেহ-মমতায় অল্প অল্প করে পড়ালেখা শেখাতেন, সেই পড়ালেখার ধরন এখন আর নেই। পড়ালেখাটা যেন অনেকটাই বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। বর্তমানে এসব কথা ভাবতে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।

মনে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখাকালে শুধু অঞ্জলী রানী ঘোষই নন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম কাজেম উদ্দিন, আলতাব হোসেন, হাফিজুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) স্যারেরা শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরেও আমাদের পাঠদান করাতেন, কিন্তু পয়সা নিতেন না। অথচ সেই আশির দশকে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কত টাকাই না বেতন পেতেন! হয়তো সামন্য বেতনে পরিবার পরিজন নিয়ে টানাটানিতেই মাস পার করেছেন কিন্তু শিক্ষকের শিক্ষকতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সে কথা এখন ভাবতে গেলে আগের দিনের ওই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধে আপনা-অপনি মাথা নুয়ে আসে। আমি আশির দশকে প্রত্যন্ত চলনবিলের তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। সে সময় আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফজলার রহমান স্যার। মূলত আমার পরবর্তী শিক্ষায় পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে তার সান্নিধ্য আমাকে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেন। যেমনটি প্রাথমিক স্তরে করেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষ। যাই হোক, কৃজ্ঞতাবশত আমাকে বলতেই হয় আমার শিক্ষা অর্জনের জন্য সে সময়কার শিক্ষকদের অবদান বেশি। অথচ আমরা যারা চাকরিজীবী আছি তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে যে খরচ হয় তা একজন ছোটখাটো চাকরিজীবীর জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি। বর্তমান সময়ে এ অবস্থা শুধু আমার না অনেকের একই। পড়ালেখার অসম্ভব প্রতিযোগিতায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এক ধরনের নাজেহাল অবস্থায় আছে। এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীকে না ছাড়ে বাবা-মা, না ছাড়ে প্রাইভেট টিউটর। তাই আমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী ঘোষের মতো মহৎপ্রাণ শিক্ষক বড়বেশি প্রয়োজন এ সময়। যারা শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ পড়ার পাঠ চুকিয়ে দিতেন দায়িত্ববোধ থেকে। কেননা সেকালে বাবা-মাদের শিক্ষার দৌড় ছিল কম। ছিল না প্রাইভেট পড়ানোর মতো আর্থিক সংগতি, তাই তাদের ওপর নির্ভর না করেই শ্রেণিকক্ষে নিজের জ্ঞান উজাড় করে পড়ালেখা শেখাতেন শিক্ষকরা। এতে করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবন গঠনে শিক্ষকদের ত্যাগ ও বিবিধ অবদান এখনো প্রাক্তন ছাত্ররা কৃতজ্ঞ ভরে স্মরণ করে।

গত ঈদে শিক্ষক অঞ্জলী রানীর প্রাক্তন শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম পল্টু একটি প্রাইভেট কার কেনেন। কারটি কিনে তিনি অস্বস্তিতে পড়েন। কারণ তিনি অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছিলেন না। অথচ তার ইচ্ছা নতুন গাড়িতে প্রথমেই ওঠাবেন তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অঞ্জলী রানীকে। তারপর ঈদের ছুটিতে এসে সোজা প্রিয় শিক্ষককে নতুন গাড়িতে তুলে তাকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরে ফিরে তবেই তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন। যা ছিল একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের কৃতজ্ঞতা, যা বর্তমান সময়ে বিরল। যাই হোক, শতসহস্র স্মৃতিতে অমার শিক্ষক অঞ্জলী রানী অমলিন। তার আদর্শ তার হাতে গড়া সহস্র শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করে। তাকে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় সাদা মনের অসাধারণ মানুষ হিসেবে। জীবনের অঙ্কে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পবিত্র মুখ ভেসে ওঠে এই মধ্য বয়সে। পাশাপাশি আক্ষেপ হয় আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষাজীবনে গল্প করার মতো একজন অঞ্জলী রানীর মতো আদর্শ শিক্ষক কি পাবে? যিনি শুধু আমার শিক্ষক থেকে হয়ে উঠেছিলেন হাজারো শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক। যার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তার সুস্থ দীর্ঘায়ু জীবন প্রত্যাশা করি এক প্রাক্তন দুষ্ট ছাত্র হিসেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close