সুদীপ্ত শামীম

  ১০ অক্টোবর, ২০২৩

মিতুর কারখানায় কাজ করে ৬০০ নারী স্বাবলম্বী

দেশের উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার নারী উদ্যোক্তা মোছা. মিতু বেগম। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ইতিমধ্যেই তিনি তার সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপও দিয়েছেন। মাত্র একটি সেলাই মেশিন দিয়ে ঘরোয়াভাবে সেলাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে মিনি গার্মেন্ট কারখানার মালিক হয়েছেন। এরই মধ্যে অন্যদেরও স্বপ্ন দেখিয়ে এখন ৬ শতাধিক নারী তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

নারী উদ্যোক্তা মিতু বেগম গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নুনিয়াগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ওই গ্রামের মো. মিজানুর রহমানের স্ত্রী।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিজ হাতে গড়া গার্মেন্টে মিতু বেগম নিরলসভাবে কাজ করেই সময় অতিবাহিত করছেন। সারাক্ষণ কাজের মধ্যেই ডুবে থাকেন তিনি। তার সঙ্গে নারীশ্রমিকরাও সারিবদ্ধভাবে বসে আপন খেয়ালে কাজ করেন।

জানা যায়, গত ২০০৯ সালে প্রথম একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাটিং ও সেলাই, হাতের কাজ, এপ্লিকের কাজ, নকশিকাঁথা, নকশি বেডশিট, বেডশিট, বুটিকের ড্রেস, চাদর, পর্দা, কুশন ও টেবিল ম্যাট তৈরি করে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করতেন। এভাবে যখন যে কাজের অর্ডার পেতেন, তখনই সেই কাজ করতেন মিতু। এভাবেই কাজ এগিয়ে যেতে থাকে মিতুর ঘরোয়া মিনি কারখানার। এর সঙ্গে দিনে দিনে বৃদ্ধি হতে থাকে নারীশ্রমিকের। এরপর মিতু গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্যদূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় পলাশবাড়ী বিআরডিবির মাধ্যমে ৩০ দিনের এমব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নিজের কারখানার নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে তাদেরও পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দেন।

ব্যবসায়িক বুদ্ধি, রুচিবোধ, গ্রাহকের মানসিকতা ও সৃজনশীল চেতনা থাকার কারণে তার তৈরি করা পণ্যের মান ভালো হওয়ায় জেলা-উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা নিউমার্কেট ও আড়ং থেকে একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে। তাদের কথামতো অর্ডার অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে নারীশ্রমিক আরো বৃদ্ধি করতে হয়। বর্তমানে কারখানায় এবং বাড়িতে কাজ করছেন ৬০০ নারীশ্রমিক। মাসে কাপড়ের বিভিন্ন কাজের অর্ডার আসে ৫ থেকে ৭ হাজার পিসের।

আগে মিতুর সংসারে একটু টানাপড়েন থাকায় এবং মায়েদের শেখানো হাতের কাজ সম্বল করে শাড়িতে পুঁথি বসানো, জরির কাজ, নকশিকাঁথা, পাঞ্জাবি, বেডশিট, ম্যাক্সি, স্কার্ট, স্কার্ফ, বিয়ের পোশাক, লেহেঙ্গা, বোরকা, পহেলা বৈশাখ ও পহেলা ফাগুনের পোশাক, বালিশের কভার, ডাইনিং সেটসহ ঘর সাজানোর আইটেম তৈরি করতেন প্রথমে। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছেন অন্যদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করে চলছেন।

কারখানাটিতে দেখা যায়, নারী শ্রমিকরা গোল হয়ে এবং সারিবদ্ধভাবে সুঁই-সুতো, জরি, জামার ওপর গ্লাসের কাজ করছেন। এ ছাড়া বেডশিট, কুশন, শাড়ি, ওড়না, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, সালোয়ার-কামিজের ওপর বিভিন্ন নকশা দিয়ে কাজ করছেন। কোনো কোনো নারী কাপড় বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাজ করে জমা দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ভ্রাম্যমাণ আরো ২০০ নারী কাজ করে থাকেন। তারা সংসারের কাজ সেরে দুটি টাকা অতিরিক্ত আয়ের আশায় নিথর বসে না থেকে মিতুর কারখানার কাপড় নিয়ে গিয়ে বাড়িতে কাজ করে জমা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কাপড় নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে অনেকেই এখন স্বামীর বোঝা না হয়ে নিজের হাত খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতে মাসের শেষে কিংবা সপ্তাহে কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে পারছেন। এতে করে সংসারেও সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

শ্রমিক তাজমিনা আকতার বলেন, আমার সংসারে খুবই অভাব ছিল। কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। কাজও তেমন একটা জানা ছিল না। ২০১৬ সালে আমার এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে পরিচয় হয় মিতু আপার সঙ্গে। তিনি আমাকে পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের এমব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ নেওয়ায়। এরপর তার কারখানায় যোগদান করি। সেই থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারছি।

আরেক নারীশ্রমিক রুমি বেগম বলেন, সংসারে সবকিছুর ঘাটতি ছিল। মিতু আপা আমাকে বিআরডিবি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দিয়ে তার কারখানায় কাজ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। নিজের চাহিদা মিটিয়ে স্বামীর হাতে দুটো টাকা তুলে দিতে পারছি। এটাই কম কীসের!

কারখানা চালাতে মিতুকে সহযোগিতা করছেন তার চাচাতো বোন মুক্তা। তিনি বলেন, আমি মিতু আপুর কারখানার যেসব নারীশ্রমিক বাড়িতে কাপড় নিয়ে গিয়ে কাজ করে তাদের নাম রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করি এবং কাপড়ের পরিমাণ লেখি। পাশাপাশি রিজেক্ট কাপড় বাছাই করি। অনেক নারীশ্রমিক আছেন যারা একটু ভুল করেছেন। আমি সেই ভুলগুলো ধরে তাদের কাছে কাজ করে নিই।

সফল নারী উদ্যোক্তা মোছা. মিতু বেগম বলেন, জীবনে কোনো কিছুই সহজ পথে আসে না। প্রতিটি পথেই কাঁটা বিছানো থাকে। আর তা উপড়ে ফেলার সাহস যাদের আছে শুধু তারাই জয়ী হবেন। আজ আমি সফল হয়েছি। দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস, মার্কেট থেকে বড় বড় অর্ডার আসছে আমার কাছে। তাদের চুক্তি মোতাবেক সঠিক সময়ে মানসম্মত মাল বুঝে দিতে হয়। এভাবে কাজ করে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে।

এ বিষয়ে পলাশবাড়ী উপজেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্যদূরীকরণ প্রকল্পের ভিশন পণ্যভিত্তিক পল্লী গঠনের লক্ষ্যে এমব্রয়ডারি ট্রেডে এক মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে মিতুকে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়। তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close