reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দুই নারী উদ্যোক্তার সফলতার সাতকাহন

তারা দুজনই পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি সফল উদ্যোক্তা। তাদের আয়ে চলে পড়াশোনার খরচ। সঙ্গে নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জন তো হচ্ছে, যা পরবর্তীতে কাজে লাগছে। সফল দুই নারী উদ্যোক্তার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

সুমাইয়া রহমান রুম্পা

ছবি আঁকতেন তিনি। একসময় ভাবলেন শুধু ক্যানভাস কেন। রংতুলির রং তো অনেক কিছুতেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আশপাশের সাদামাটা অনেক কিছুই হয়ে উঠতে পারে রঙিন। আকর্ষণীয়, চমৎকার। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তুলির আঁচড়ে মাটির নানা জিনিস তার হাতে পেল ভিন্ন এক রূপ। অপরূপ পণ্যগুলো মানুষের পছন্দের জায়গা দখল করে নিয়েছে অল্প দিনেই। তিনি হয়ে উঠেছেন একজন উদ্যোক্তা। এতক্ষণ যার গল্প বলা হলো তিনি হলেন সুমাইয়া রহমান রুম্পা। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। পাশাপাশি অনলাইনে মাটির শোপিজ, মাটির টব, মাটির ব্যাংক, হ্যান্ড পেইন্ট মাস্ক, এক কালার সুতির মাস্ক, হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি, হ্যান্ড পেইন্ট পাঞ্জাবি, হ্যান্ড পেইন্ট শাল, হ্যান্ড পেইন্ট কাপল সেট, পাটের হ্যান্ড পেইন্ট ব্যাগ, ক্যানভাস, কাঠের গহনা, হ্যান্ড পেইন্ট ডাইরি, কাপ্তান, সুপারি পাতার প্লেট, ম্যাক্রেমের সিকা, হ্যান্ড পেইন্ট ব্লাউজ, হ্যান্ড পেইন্ট ওয়ান পিস, বুকমার্ক ইত্যাদি বিক্রি করেন। ২০০ টাকা তার প্রথম আয় হলেও এখন সব খরচ বাদে মাস শেষে থাকে সাত হাজার টাকার মতো। একজন স্টুডেন্টের জন্য এটা নেহায়েতই কম নয়। ক্লাস, পরীক্ষা, আড্ডা, অ্যাসাইমেন্ট করে যখন অন্যরা হাঁসফাঁস করেন। তখন রুম্পা অন্যদের মতো সব কাজ তো করেনই আবার ব্যবসাটাও নিজ হাতে সামলান। পরিশ্রম হলেও সব কিছু তিনি উপভোগ করেন।

বড় বোন, বাবা, মা এই নিয়ে তার পরিবার। অবশ্য শখের বিড়াল ম্যাক্রিও আছে। ২০২১ সালের ৬ জুলাই খোলা তার ফেসবুক পেজে লাইক হয়েছে ১৩০০, ফলোয়ার আছে ১৪০০। তার পেজের নাম Hobby lobby club.অবশ্য লাইক ফলো যাই হোক। তিনি কিছু রিপিট ক্রেতা তৈরি করতে পেরেছেন। যারা বারবার তার থেকেই পণ্য ক্রয় করে। অন্যদের কিনতে উৎসাহ জোগায়। আর্ট তিনি ছোটবেলা থেকেই করেন। করোনার সময় অখন্ড অবসর। তখন ভাবলেন, কিছু একটা করবেন। হাতে ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা। কিছু রং, তুলি কিনে কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলেন, কাজ তার ভালোই হচ্ছে। মানুষ ক্রয় করতে চাচ্ছে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। অনলাইনে তো অনেকেই পণ্য বিক্রি করে। এমন কি আছে যে মানুষ আপনার থেকে পণ্য ক্রয় করবে? এমন প্রশ্নে রুম্পা বলেন, আমি আমার কাজে সবসময় নতুনত্ব কিছু রাখার চেষ্টা করি। যারা নিজেদের সবার থেকে ডিফরেন্ট ভাবে সাজাতে চায় তাদের জন্যই আমার কাজ। আর পণ্যের মানে বিন্দুমাত্র আপোস করি না। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে যেন পণ্যটি গ্রাহকের মন মতো হয়। যেমন মাটির পণ্যের ক্ষেত্রে আমি বার্নিস ব্যবহার করি এবং কাপড়ের ক্ষেত্রে ক্যামিকেল ব্যবহার করি যাতে এর উজ্জ্বলতা নষ্ট না হয়। ৫০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা দামের পণ্য রুম্পার ভান্ডারে রয়েছে। অর্ডার কনফার্ম করে কিছু টাকা এডভান্স করতে হয়। কুরিয়ারে যদি পণ্য নষ্টও হয়। তবে সে জন্য ক্রেতার কোনো ক্ষতি নেই। কারণ পণ্য নষ্ট হলে তার জন্য পূনরায় পণ্য পাঠানো হয় বা টাকা ফেরত দেওয়া হয়। যখন ব্যবসা শুরু করেন। লাইভে আসতেন প্রায়ই। তখন কিছু মানুষ বাজে কমেন্ট করত। অবশ্য এসব পাত্তা দেওয়ার সময় তার কখনোই হয়ে উঠেনি। আয় যা হয়, খানিকটা নিজের ও পরিবারের জন্য ব্যয় করেন। বাকিটা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ব্যবসাটাকে অনেক দুর নিয়ে যেতে চান তিনি। সব কাজ নিজেই করেন। সেই মাটির পণ্য সংগ্্রহ, রং, কাপড় কেনা পর্যন্ত।

নিউমাকেট, গাউছিয়া থেকে সংগ্রহ করেন কাঁচামাল। তবে সাহায্যের প্রয়োজন হলে বড় বোন, এক বন্ধুকে পাশে পান তিনি। রুম্পা জানান, তার পেইজের মূল ৯৫ শতাংশ ক্রেতাই নারী। স্টুডেন্ট থেকে চাকরিজীবী, গৃহিণী শৌখিন মানুষজন। রুম্পা দক্ষতা অর্জনে খুব সচেষ্ট। তিনি ২০২০ এ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (স্কিটি) থেকে Industrial compliance Managemen কোর্স এবং ২০২১ এ বিসিক অনুমোদিত WIFI থেকে ফেসবুক মার্কেটিং নিয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন। উদ্যোক্তা হতে হলে নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। অভিজ্ঞতার আলোকে রুম্পা বলেন, আমার মতে প্রতিটা নারীর নিজের একটা পরিচয় থাকা দরকার। একটু সাহস করলেই সবকিছু করা সম্ভব। আমি পারব না, আমার দ্বারা হবে না এ কথাগুলো জয় করতে পারলেই সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সর্ম্পকে তিনি বলেন, নিজের একটা শো রুম খুলবেন। যেখানে বিভিন্নরকমে পণ্য থাকবে। Hobby lobby club-এর নিজস্ব একটা পরিচয় হবে। আর মৃৎশিল্পী নিয়ে আরো বড় পরিসরে কাজ করতে চান তিনি।

নুসরাত জাহান নির্জনা

পড়াশোনার পাশাপাশি এখনকার তরুণ-তরুণীরা নানা ধরনের শৌখিন কাজ করে। অবসর সময়ে তাদের এসব কাজে দুটি লাভ হয়। পকেট খরচের টাকা আসে এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়। যা পরবর্তী জীবনে কাজে লাগতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্রী নুসরাত জাহান নির্জনা এমনই একজন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকেন। তার নির’স প্যাশন নামে একটি ফেসবুক পেজ আছে। যেটার মাধ্যমে ছবির বিক্রি করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তার ছবি আঁকাআকির প্রতি ঝোঁক। তখন ৪র্থ শ্রেণিতে পড়েন। একটি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হন। সেটি ছিল গ্রামের একটি দৃশ্য। প্রাকৃতিক দৃশ্য তার খুব পছন্দ।

ছবি আঁকার মধ্যে আশার আলো দেখতে পান তিনি। মানসিক শান্তি অনুভব করেন। সে কারণে ছবি আঁকা তার প্রিয় বলে জানান। ক্যানভাসে এক্রেলিক রং দিয়ে আঁকা ছবিগুলোর স্থায়িত্ব বেশি। সঙ্গে সামান্য বার্নিশ দিয়ে দেন। যা ছবিকে আরো টেকশই করে তোলে। এ পর্যন্ত নির্জনা কয়েকশ ছবি এঁকেছেন বলে জানান। কিন্তু এতে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হয়নি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, পড়াশোনার পরে অবসর সময়ে ছবি আঁকি। তাই ক্ষতি হবার সুযোগ তেমন নেই। প্রতি মাসে ছবি বিক্রি করে যে আয় হয়। তাতে নির্জনা সন্তুষ্ট। তিনি মনে করেন, স্টুডেন্টরা পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি এঁকে আয় করতে পারে। তবে প্রথম দিকে সফলতা না পেলেও হতাশ হওয়া যাবে না।

অসংখ্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন নির্জনা। এর মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় ৩য় হয়েছেন। শুধু ছবি আঁকা নিয়ে প্রায় ৫০টির মতো সাটিফিকেট আছে তার। তার আঁকা ছবি শিল্প-বাংলা আর্ট এক্সিবিশন ২০২২ (২৭-৩০ জুন), অ্যানুয়াল স্টুডেন্ট আর্ট শো হেলড ইন দুবাই, ইন্টারন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশন (৫-৬ নভেম্বর, ২০২২), সিক্সথ টিউন অব আর্ট হেল্ড ইন বাংলাদেশ, সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভ্যাল (২৬-২৮ ডিসেম্বর, ২০২২), ওয়ে টু আর্টির্স্টি ড্রিম আর্ট এক্সিবিশন (২৩-২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২) এ শিল্পবোদ্বাদের ব্যাপক প্রশংসা পায় বলে জানান। দুবাই এক্সিবিশনে নির্জনার ছবি ছিল। এটি তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা বলে জানান তিনি। মানুষ ছবির শিল্পমূল্য বুঝে না। আলু পটলের মতো ছবির দরদাম করে। আজেবাজে কথা বলে। এই বিষয়গুলো নির্জনাকে খুব কষ্ট দেয় বলে জানান। নতুন যারা ছবি আঁকতে চায় তাদের জন্য নির্জনার পরামর্শ হলো, অনেক ধৈর্য রাখতে হবে। শুধু বিক্রির জন্য ছবি আঁকবেন এই মনোভাব রাখা যাবে না। ছবি আঁকার মাঝে আপনারা শান্তি খুঁজে পাবেন যখন আপনি ভালো ফলাফল পাবেন। হতাশ হওয়া যাবে না। ভবিষ্যতে ছবি আঁকা নিয়ে নির্জনার পরিকল্পনা হলো নিজস্ব আর্ট গ্যালারি করবেন। ছবি আঁকা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ভাবনাও আছে তার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close