নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৭ মে, ২০২৪

এমপিদের চেয়ে সম্পদশালী চেয়ারম্যানরা

দেশে বিগত পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। পাঁচ বছরে সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ। কিন্তু একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি।

দেশে আগামীকাল বুধবার (৮ মে) উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট উপলক্ষে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে গতকাল সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, এবার প্রথম ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে ১১৭ জন কোটিপতি। বাকিরাও কাছাকাছি সম্পদের অধিকারী। চলতি উপজেলা নির্বাচনে আগেরবারের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা।

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪ (১ম ধাপ) এর প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে টিআইবি জানায়, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে বের হয়েছে পেশা হিসেবে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৪ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।

টিআইবি বলছে, এবার উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ১১৭ জন কোটিপতি। ৫৬০ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৯৪ জন কোটিপতি। ৬১১ ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৭ জন ও ৪৩৫ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন কোটিপতি।

টিআইবি বলছে, প্রথম ধাপের ১৫২টি উপজেলার মধ্যে ১৪৪টির প্রার্থীদের হলফনামা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে, বাকি আটটি করেনি। ১৫২টি উপজেলার তিনটি নির্বাচনের প্রায় ৪ হাজার ৮০০টি হলফনামায় দেওয়া আট ধরনের তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর রিফাত রহমান, কে এম রফিকুল আলম ও ইকরামুল হক ইভান।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়টি নির্বাচন কমিশন, এনবিআর ও দুদকের খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বলে মনে করি।

ড. মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম ধাপেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬ প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটি স্থানীয় প্রার্থীদের আটকাতে পারেনি। আগ্রহী প্রার্থীরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।

টিআইবি জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশ। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯.৮৬ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৬.৫৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৪.৩৭ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।

নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫২ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। আয় নেই ১২ শতাংশের, ৩৯ শতাংশ নিজেদের আয়ের কোনো স্বীকৃত উৎস দেখাননি।

টিআইবির গবেষণা বলছে, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪০ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ শতাংশ প্রার্থী। প্রার্থীদের প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি ৭ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি। দ্বিগুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা।

অন্যদিকে ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর এর বেশি জমি আছে কমপক্ষে ১০ জন প্রার্থীর। ২৩.৪১ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫২৮ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে সিলেটের বিশ্বনাথের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর। প্রার্থীদের ১৬.৬৪ শতাংশ বর্তমানে মামলায় অভিযুক্ত।

৫ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩৩১৯ শতাংশ, ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১৮২৩ শতাংশ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ৪২৫১ শতাংশ।

স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১২৪০ শতাংশ। ৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে এ হার সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৪২০০ শতাংশের বেশি।

টিআইবি বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের দাপট বাড়ছে, অনেকেরই অবিশ্বাস্য হারে আয় ও সম্পদের বিকাশ ঘটেছে। ফলে জনস্বার্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা মুনাফাকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। টিআইবির পক্ষ থেকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়েও এখন জনস্বার্থ উপেক্ষা করে নির্বাচনকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্ব ক্ষমতাকেন্দ্রিক। জনস্বার্থ নয় বরং ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার দলীয় শৃঙ্খলা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত মেনে চলার মতো যে ধরনের আচরণ রাজনৈতিক দলের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশিত তা ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। যেহেতু ক্ষমতায় যেতে পারলে সম্পদ বিকাশের সীমাহীন সুযোগ তৈরি হয়, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়, ফলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে।

স্থানীয় নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ফলাফলকে বিস্ময়কর উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হলফনামা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, অনেক জনপ্রতিনিধির আয় অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের চেয়েও বেশি। হলফনামায় যথাযথ কিংবা পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো প্রার্থীর আয় খুবই কম দেখানো হয়েছে।

প্রার্থীদের যাদের আয় ও সম্পদ গগণচুম্বিহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বা তাদের নির্ভরশীলদের আয়-সম্পদের যে বিপুল বিকাশ ঘটেছে, বৈধ সূত্রের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না এ প্রশ্নও অত্যন্ত যৌক্তিক। বাস্তবতা হলো, প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনগণ শুধু তথ্যই জানতে পারছে। তবে তার সত্যতা ও যথার্থতা যেমন দেখতে পারছি না একইভাবে আইনের প্রয়োগ কিংবা ফল কোনোটিই দেখছি না। অথচ এই হলফনামার সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিতের দায়িত্ব যাদের সেই নির্বাচন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে খতিয়ে দেখার দায়িত্বটি পালন করছে না, যা হতাশাজনক।

হলফনামা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে নারী প্রার্থী আছেন মাত্র ২৫ জন। অন্যদিকে, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪০ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি ৭ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close