নিজস্ব প্রতিবেদক ও বান্দরবান প্রতিনিধি

  ০৮ এপ্রিল, ২০২৪

পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান

ব্যাংক ও অস্ত্র লুট, হামলা-অপহরণের ঘটনায় বান্দরবানের থানচি ও রুমায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশ। সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আস্তানা শনাক্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন। এ পরিস্থিতিতে চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে দুই উপজেলায়; থমথমে ভাব কাটেনি আশপাশের এলাকাগুলোয়ও। তবে অভিযানে যেন জনসাধারণকে হায়রানিতে পড়তে না হয় সে আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গতকাল রবিবার বিশেষ যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বম (৫৫)। চেওসিম বম বান্দরবানের সুয়ালক ইউপির ৬নম্বর ওয়ার্ডের শ্যারণ পাড়ার মৃত বোয়াল কুম বমের ছেলে।

এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ বলেন, চেওসিম বম কেএনএফ সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং সংগঠনটির প্রধান নাথান বমের সঙ্গে তার আত্মীয়তা রয়েছে। চেওসিম সংগঠনের অর্থ সংগ্রাহক এবং জামাতুল আনসার ফিল ইন্দাল শারক্কিয়ার জঙ্গি নেতা শামীম মাহফুজ ও নাথান বমের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চুক্তির মূল সমন্বয়কারী। ওই চুক্তি হয়েছিল শ্যারণ পাড়ায় চেওসিম বমের বাড়িতে।

সরেজমিনে দেখা যায়, রুমা বাজারে আগের মতো জনসমাগম নেই। সন্ধ্যা হতে না হতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট। আতঙ্কে গণমাধ্যমের সামনেও আসছেন না বাসিন্দারা। এদিকে কেএনএফের আস্তানা চিহ্নিত করতে ড্রোন ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। এ ড্রোনে ১৬ হাজার ফুট ওপর থেকে দেখা যায়, চারপাশের ২০ হাজার ফিট এলাকা। এর মাধ্যমে চেষ্টা চলছে কুকি-চিনের অবস্থান শনাক্তের। তোলা হচ্ছে ভিডিও ও স্থিরচিত্র। দেখা হচ্ছে সন্দেহজনক কোনো গতিবিধি চোখে পড়ে কিনা। দুর্গম এলাকায় অভিযানের আগে এ ড্রোনের মাধ্যমেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নেন সেনা সদস্যরা।

এলাকা পরিদর্শন সেনাপ্রধানের : পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গতকাল বান্দরবান এলাকা পরিদর্শন করেছেন সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। পাহাড়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, আপনারা জেনেছেন শনিবার রাতে কিছু সন্ত্রাসীকে ধরতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র‍্যাব, বিজিবি, পুলিশের যৌথ অভিযান চলবে।

সেনাপ্রধান বলেন, দৃশ্যমান কিছু কার্যক্রম আপনারা দেখতে পাবেন। এর ফল আপনারা সময় মতো পাবেন। আমি আপনাদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চাই, আমার কাছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের শান্তির জন্য, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যা করণীয়, প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ সেটাই করতে হবে। সেটা বাস্তবায়নে আমরা সক্ষম হব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি।

সেনাপ্রধান বলেন, এর আগে কুকি-চিন সমতলে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে অস্ত্র চালানো, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর ২০২২-২৩ সালে বিভিন্ন সময়ে যৌথ অভিযানে সন্ত্রাসীদের মূল ক্যাম্পসহ তাদের অনেক আস্তানা দখলে নিয়েছিল যৌথবাহিনী। পরে শান্তিপ্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে শান্তির আলোচনার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তারা ধীরে ধীরে আবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে তাদের অবস্থান জাহির করেছে। সে সব বিষয় মাথায় রেখে এবার অভিযানে আমাদের যৌথ বাহিনীর যত সক্ষমতা আছে সব কিছু কাজে লাগিয়ে তাদের মূলোৎপাটন করতে অভিযান চলছে এবং চলবে। সেনাপ্রধান বলেন, সন্ত্রাসীদের এ স্বাধীন সার্বভৌমত্বের ভূখণ্ডে কোনো স্থান নেই। তাদের কোনোভাবে ঠাঁই দেওয়া হবে না। তাদের পুরোদমে নির্মূল করে শান্তির পাহাড়ে পুনরায় শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতীতে কাজ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। শুধু পাহাড়ে নয়, দেশে যেখানে অশান্তি হবে সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করবে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাত ৮টায় বান্দরবানের রুমা উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে অস্ত্র ও টাকা লুট করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ সময় তারা ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকেই ফের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে কেএনএফ। এর পরদিন (বুধবার) দুপুরে থানচি বাজারে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালানো হয়। দুদিনের অভিযানের পর র‌্যাবের মধ্যস্থতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর রুমা বাজারের পাশের এলাকা থেকে নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়। মূলত কেএনএফর বিরুদ্ধে শুক্রবার থেকেই সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে র‍্যাব। বাহিনীটি বলেছে, অভিযানে ‘পাহাড়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল’ প্রয়োগ করা হবে।

কেএনএফ কতটা শক্তিশালী : কেএনএফের দাবি, বান্দরবান ও রাঙামাটির অন্তত ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবে প্রচার করছে অনেকে। ২০২২ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্য দাবি করে কেএনএফ। তখনই সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করে তারা। একই বছর পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গি বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।

এদিকে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, থানচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার ঘিরে দুটি ব্যাংকের শাখায় হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানারই দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে থাকতে পারে বলে তারা মনে করছে।

বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। প্রথমত, টাকা লুট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা। সক্ষমতা বলতে কেএনএফের শক্তি বা সামর্থ্যের কথা বোঝানো হলে এ প্রশ্নও আসে যে, কেএনএফ প্রকৃত অর্থে কতটা শক্তিশালী।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কেএনএফ তাদের অস্ত্রের মজুত বাড়িয়েছে। শক্তি বৃদ্ধি করেছে তাদের সশস্ত্র শাখার। কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে হামলা করছে। আগের তুলনায় ৩-৪ গুণ সদস্য বাড়িয়ে কেএনএফ এখন আরো দুর্ধর্ষ। তাদের সক্রিয় নারী সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি ও থানচি থানায় হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। সংগঠনটির সশস্ত্র শাখাকে চিহ্নিত করার জন্য একাধিক টিম গঠন করেছে পুলিশ।

রুমা ও থানচিতে হামলার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনার জন্য কেএনএফকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কেএনএফ এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।

থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন জানান, তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশপাশের পাহাড়ে তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close