বদরুল আলম মজুমদার

  ০১ এপ্রিল, ২০২৪

বিএনপির বিদেশনীতি হ-য-ব-র-ল

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর ভারতকে ম্যানেজ করতে পুরোনো নীতি থেকে অনেকটাই সরে আসে বিএনপি। তাই বিশ্বের অন্য পরাশক্তির নেতৃত্বে থাকা চীনকে কাছে টানার বিষয়ে বরাবরই উদাসীন ছিল দলটি। মূলত পশ্চিমা পরাশক্তিনির্ভর একপক্ষীয় বিদেশনীতির ওপর ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু জিও পলিটিক্সের মারপ্যাঁচ ও বহু পক্ষীয় ভারসাম্যপূর্ণ বিদেশনীতির গলদের খেসারত দিতে হচ্ছে দলকে। এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দলের বিদেশনীতি কোন পলিসিতে এগোবে, তা ঠিক করতে পারছেন না খোদ দলের শীর্ষ নেতারাই।

দলের এমন সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই ভারতের পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে সংহতি জানায় বিএনপি। সরাসরি ভারত বিরোধিতায় না গিয়ে দলটির অধিকাংশ নেতা পণ্য বর্জন কর্মসূচির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। আংশিক এই ভারতবিরোধী অবস্থান দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে দলের অনেক নেতার মত।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের জনগণ ভোটাধিকার হরণের জন্য ভারতকে দায়ী করে আসছে। সরকারি দলের নেতাদের কথায় সেটার প্রমাণও উঠে আসছে। এ অবস্থায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে ভারতকে নতুন বার্তা দেওয়ার কৌশল নিয়েছে দলটি। যদিও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি ভারতের মন জয়ের ক্রমাগত চেষ্টা করে আসছিল।

বিএনপির বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন নেতার ভাষ্য, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে সংহতি জানিয়ে দেশটিকে আলোচনার টেবিলে আনা যাবে না। ইসলামপন্থি দলগুলোর মতো দেশের জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ অংশ ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। বিএনপির অতীত নীতিও অনেকটা ভারতবিরোধীই ছিল। তাই দলটিকে হয় সরাসরি ভারতবিরোধী রাজনীতি করতে হবে, নতুবা ভারতকে কাছে টানার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। দূরে থেকে পণ্য বর্জন কর্মসূচি দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে চাপ প্রয়োগ কৌশল খুব একটা কাজে দেবে না।

দলকে পুরোপুরি ভারতবিরোধী অবস্থানে যেতে হবে। চীনসহ পশ্চিমাবিরোধী শিবিরে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করেন এমন একজন নেতা প্রতিবেদককে বলেন, মানবাধিকার বা ভোটাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যেভাবে সোচ্চার ছিল, সেটা অবশ্যই বিএনপির কূটনীতিক সফলতা হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থতির কারণে ভারতকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোনো সুযোগ ছিল না। তাই ভিসানীতিসহ নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের চাওয়াকেই গুরুত্ব দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির উচিত ছিল একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরপরই ভারতের ওপর বিভিন্ন উপায়ে চাপ বাড়ানোর কৌশল নেওয়া। এখন যে পণ্য বর্জন কর্মসূচির সংহতি দেওয়া হয়েছে, সেটা দুই বছর আগে শুরু করলেও বিএনপিকে নির্বাচনের আনার উদ্যেগ ভারতের পক্ষ থেকে নেওয়া হতো। বিএনপির ব্যাপারে গতবারের মতো এতটা চুপ থাকত না।

দলের বিদেশবিষয়ক কার্যক্রমে বিএনপি ব্যর্থ বা পলিসিগত গলদ আছে কি না- এমন প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ব্যর্থ বা গলদ আছে কি না- এটা আপনারা যেভাবে মূল্যায়ন করেন, আমরা সেভাবে দেখি না, জিও পলিটিক্সের কারণে অনেক কিছুই হয়ে উঠে না। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বিএনপির ফরেন রিলেশনস কমিটি (এফআরসি) ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দলের বিদেশবিষয়ক নীতিতে আবারও চীনকে গুরুত্ব দেওয়ার আলোচনা রয়েছে। চীনের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এরই মধ্যে দলের একজন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের দায়িত্বশীলকে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।

বিদেশবিষয়ক কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, ‘প্রোগ্রাম ও পলিসির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সম্প্রতি ভারত-বিরোধিতার বিষয়টিকে অনেকেই দলের পলিসি মনে করলেও আদতে সে চিন্তা নেই বিএনপির। সামাজিকভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি ‘প্রোগ্রামগত’ বিষয়। এক্ষেত্রে পলিসিকে মিলিয়ে ফেললে হবে না। বিএনপির পলিসি জিয়াউর রহমানের আদলেই সাজানো আছে, সেটাতেই থাকতে চায় দল।

বিদায়ি বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে কূটনীতিক পাড়ায় বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের দৌড় ছিল চোখে পড়ার মতো। মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর ২৫ মে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ছিলেন সেখানে।

বিদায়ি বছরের ১১-১৪ জুলাই ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু-সহ চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। ওই দলের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের বৈঠক হয়নি। তবে ডোনাল্ড লু ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির বার্তা নিয়ে যান।

তবে নির্বাচনের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খান। নির্বাচনের আগে আন্দোলন চলাকালে ভারতের দিল্লিতে নানা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফররত ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তারের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদ।

দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘নির্বাচন-পূর্ব দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকগুলোয় বন্ধু রাষ্ট্র কী বার্তা দিয়েছিল এবং বাস্তবে কী করা হয়েছে, তা আলোচনায় এসেছে। এই আলোচনার ভেতরেই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টিকে নতুন করে ঝালাই করার।’

প্রভাবশালী এই দায়িত্বশীল আরো বলেন, ‘আঞ্চলিক পলিসি বোঝালে ভারত ও চায়নার প্রসঙ্গ আসে। বিশেষ করে গত বছরের ২৩ অক্টোবর ইন্দো প্যাসেফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কৌশলপত্র ঘোষণা করে বিএনপি। তাহলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কৌশল নিয়ে কী অবস্থান নেবে বিএনপি।

কৌশলপত্র নিয়ে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা, নিয়মতান্ত্রিকব্যবস্থা, সম্প্রীতি, নিরাপদ নৌ-চলাচল, টেকসই অর্থনীতি, মুক্তবাণিজ্য, জলবায়ু, স্বাস্থ্য, মহামারির মতো হুমকিগুলো মোকাবিলার পাশাপাশি একটি অবাধ, মুক্ত, উদার, গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল গ্রহণ করছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফআরসির প্রধান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘কারো সঙ্গে দূরত্বের কিছু নাই আমাদের। সরকারের সঙ্গে সরকারের বাইলেটারাল সম্পর্ক থাকেই। আমি তো বিএনপির সঙ্গে চীনের দূরত্ব দেখি না। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, চীন সরকার তাদের সঙ্গে কাজ করছে।

আমির খসরু আরো বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, ‘দেশের স্বার্থ বজায় রেখে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক’। আমিও মনে করি, সেভাবে বিএনপির ডিপ্লোম্যাসি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ এখন যেমন ভারতের ওপর রেগে আছে, কারণ মানুষ মনে করে- গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যত নিপীড়ন অত্যাচার করে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আছে, আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতিনিয়ত সেটা বলছেনও, এসব কারণে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে। এটা ন্যাচারাল প্রতিক্রিয়া।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close