বিশেষ প্রতিবেদক

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রেলের অর্থ আত্মসাৎ

ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব বিভাগ ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে। ঘটনা ধরা পড়ার পর পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর সাত কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গত ১১ ফেব্রুয়ারি। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় কোথায় কোথায় কে কে জড়িত, তার জন্য অনুসন্ধান চলছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক কামরুল আহসান প্রতিদিনের সংবাদকে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, তদন্ত চলছে। এ দুর্নীতিতে জড়িত কাউকেই ছাড় দেব না আমরা। বাংলাদেশ রেলওয়ের যে সাতজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের কেউ কেউ বা সবাই যুক্ত থাকার প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। দরকার হলে অপরাধীর কাছ থেকে অর্থ আমরা আদায় করব। এভাবে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ হতে পারে না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দি কসমোপলিটন করপোরেশনের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে মালামাল কেনা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য। তার মধ্যে ৪টি কাজের বিল বাবদ ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা ওই প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব দপ্তরকে চিঠি দেন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন। পরে নিয়মানুসারে, অর্থ উত্তোলনও করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর মধ্যে ধরা পড়ে- ওই প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার বাইরে বাড়তি ৯৭ লাখ টাকা বিল ওেয়া হয়েছে কসমোপলিটন করপোরেশনের নামেই। সোহাগ আলী নামে এক ব্যক্তি সীমান্ত ব্যাংকের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখা থেকে পুরো টাকা উত্তোলন করেন। বিষয়টি দি কসমোপলিটন করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী নাবিল আহসান জানেনই না।

জানা গেছে, কসমোপলিটন করপোরেশনের কার্যালয় ঢাকার ইস্কাটনে। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নাবিল আহসান। তিনি বৃহস্পতিবার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমি এ মাসের শুরুতে জানতে পারি- রেলওয়ের পঞ্চম চেক ইস্যু করেছে। রেলের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সহায়তায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ৯৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে সীমান্ত ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে। ওই ব্যাংকে আমার প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। সোহাগ আলী নামে কোনো ব্যক্তির সঙ্গেও আমার পরিচয় নেই। সীমান্ত ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ওই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে গত বছরের শেষদিকে। সেখানে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কসমোপলিটন হলেও স্বত্বাধিকারী হিসেবে রয়েছে কোহিনূর আক্তার নামে এক ব্যক্তির। আর ঠিকানা দেখানো হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম মাজহারুল ইসলাম দি কসমোপলিটন করপোরেশনের ঢাকার ইস্কাটনের কার্যালয়ের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে জানান, সোহাগ আলী নামে এক ব্যক্তি গত ১২ ডিসেম্বর কসমোপলিটনের প্রতিনিধি হিসেবে চেক গ্রহণ করেছেন। এ চেক ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। তখন নাবিল আহসান এ বিষয়ে কিছুই অবগত নন বলে বাংলাদেশ রেলওয়েকে জানান। এ বিষয়ে নাবিল আহসান বলেন, আমি ও আমার প্রতিষ্ঠানের কেউ কোনোভাবেই এ সন্দেহজনক পঞ্চম চেকটির সম্পর্কে অবগত নই, সম্পৃক্ত নই। রেলওয়ের হিসাব বিভাগের সংশ্লিষ্টরা অসৎ উদ্দেশ্যে গুরুতর আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বিল প্রক্রিয়াকরণ থেকে তা অনুমোদন পর্যন্ত এবং চেক ইস্যু থেকে তা হস্তান্তর পর্যন্ত সরাসরি জড়িত ও দায়ী, যা রেলওয়ের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা (পূর্ব) এর দায় এড়াতে পারেন না। শুধু আমার প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মিল রেখে জালিয়াতচক্র ও রেলের হিসাব বিভাগের সংশ্লিষ্টদের অনিয়মে এ অপরাধ সংঘটিত হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান খান এরই মধ্যে বলেছেন, রেলওয়ের হিসাব বিভাগের কর্মী, ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সহযোগিতার ফলেই এ অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংকের লেনদেন সম্পর্কে জানাতে তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন বলেন, তার দপ্তর থেকে ৯৭ লাখ টাকার মালামাল গ্রহণের কাগজপত্র হিসাব দপ্তরে পাঠানো হয়নি। পরে হিসাব শাখা থেকে একই প্রতিষ্ঠানের নাম সংযোজন করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ফরিদ উদ্দীন অভিযোগ করেন, হিসাব শাখার দপ্তরগুলোর যোগসাজশে সরকারি টাকা লোপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিল আইবাস সিস্টেমে এন্ট্রি করা থেকে চেক ইস্যু করা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পণ্য সরবরাহের আদেশ, পণ্যের চালানসহ বেশকিছু ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়। এর কোনোটি ছাড়া বিল পরিশোধ সম্ভব নয়।

এ ঘটনা তদন্তের জন্য রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব কর্মকর্তা জয়শ্রী মজুমদারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত চলছে। জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টার দপ্তরে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তার মধ্যে আছেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, অনলাইনে ডাটা এন্ট্রিকারী, বুক অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও দপ্তরের হিসাবরক্ষক। অনলাইন বিল এন্ট্রি সিস্টেম বা আইবাস পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণশারী, চেক ইস্যুকারী ও চেক হস্তান্তরকারী।

এ ঘটনার পর কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তদন্ত দলের সামনে। দি কসমোপলিটন করপোরেশন ঢাকার অনুকূলে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং বিল পরিশোধের ফরোয়ার্ডিং ছাড়া রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পঞ্চম বিলটি কেন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন করলেন? নিয়ম থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পঞ্চম বিলটির তথ্য কোথাও কোনো রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করেননি। রেলওয়ের ডিএফএ স্টোরসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কীভাবে পঞ্চম বিলটি যাচাই-বাছাই না করেই আইবাস সিস্টেমে কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট আইডি থেকে অনলাইনে লগইন করে বিলটি এন্ট্রি ও অনুমোদন করলেন? আইনগত নিয়ম হচ্ছে, যেকোনো চেক প্রসেস ও ইস্যুর ক্ষেত্রে রেলওয়ের বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ডিএফএ স্টোরস শাখার রিসিভিং রেজিস্ট্রারের গ্রহণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পাস করা বিলের সব কাগজপত্রসহ ফাইলটি গ্রহণ করা হয়। কেন বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা পঞ্চম বিলের কাগজপত্র রিসিভিং রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে নিয়ম ছাড়াই গ্রহণ করেন? বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিলের কপিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের তথ্য লিখিতভাবে উল্লেখ না করেই ‘সাদা বিলে’ কেন চেক প্রসেস করে তা চেক ইসু্যু করলেন? বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার ইস্যু করা চেকটি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অথরাইজেশনপত্র ছাড়াই অজ্ঞাতব্যক্তির কাছে চেক হস্তান্তর করেন? চেক গ্রহণকরী ব্যক্তির জাতীয়পরিচয়পত্র কি গ্রহণ করা হয়েছিল?

জানা গেছে, বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার গ্রহণ করা অনুমোদিত বিলসংক্রান্ত কাগজপত্র এবং ক্যাশ অর্ডার সাতের (সিও সেভেন) সঠিকতা যাচাই করে এবং একইসঙ্গে আইবাস সিস্টেম অনুমোদিত বিলের সত্যতা যাচাই করে চেক প্রসেস কার্যক্রম শুরু করে। বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিলের কাগজে চেক গ্রহণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত ব্যাংকের তথ্য উল্লেখ করে। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সবকিছু সুনিশ্চিত হলেই শুধু তখন চেকটি চূড়ান্ত ইস্যু করেন। ইস্যু করা চেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে আইনানুযায়ী হস্তান্তর করার পর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর চেক পাসের জন্য অ্যাডভাইজিং প্রেরণ করে বিল পাসের কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করে।

সন্দেহজনক পঞ্চম বিল প্রসেসের প্রতিটি ধাপে গুরুতর অনিয়ম, দায়িত্বে গাফিলতি ও জালিয়াতির বিবরণ : সন্দেহজনক পঞ্চম বিলের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোনো বিলের কপি, আর/নোট কপি, বিল ফরোয়ার্ডিংপত্রের কপি পাঠানো হয়নি ডিএফএ স্টোরস হিসাব শাখায়। সিসিএস দপ্তরের বাজেট অনুমোদন ও বিল পাসের ফরোয়ার্ডিংপত্র ব্যতীত হিসাব বিভাগের নিজ উদ্যোগে বিল পাস করে চেক ইস্যু করার কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই। সীমান্ত ব্যাংক আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম শাখায় ওই চেক এনক্যাশ করা হয় বলে রেলওয়ে থেকে জানা যায়, যে অ্যাকাউন্টে চেকটি ক্যাশ করা হয়, তা দি কসমোপলিটান করপোরেশন ঢাকার অ্যাকাউন্টই নয়। ওই ব্যাংকে চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে দিয়ে দি কসমোপলিটান করপোরেশনের নামের সঙ্গে শুধু মিল রেখে এক নারী কর্তৃক ভুয়া কর্ণধার সেজে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ওপেন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডিএফএ স্টোরস এবং বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার সঙ্গে যোগসাজেশে ওই ভুয়া কর্ণধার ও জালিয়াত চক্র কর্তৃক দি কসমোপলিটান করপোরেশন ঢাকার মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শুধু নামের মিল রেখে অজ্ঞাতব্যক্তি দ্বারা চেক আদান-প্রদান ও ব্যাংক থেকে টাকা নগদায়ন করা হয়।

হাবিব উল্লা খান হাবিব (টিএলআর, এফএঅ্যান্ডসিএও স্টোর সিআরবি), তিনি কম্পিউটারে আইবাস সিস্টেমে ঢুকে সবার আগে সন্দেহজনক ভুয়া পঞ্চম বিলটি এন্ট্রি দিয়ে টোকেন নম্বর ০০১৫৩০৩১ তৈরির মাধ্যমে জালিয়াতির প্রাথমিক সূচনা করেন। হাবিব উল্লা খান হাবিব এবং চেক ইস্যুকাকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বুকস অ্যান্ড বাজেট শাখার মো. আবু নাসেরের মধ্যে সখ্য রয়েছে। এ ঘটনা জানাজানি হলে হাবিব উল্লাহ খান হাবিব গত ৮ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মামুন হোসেন (হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, এফএঅ্যান্ডসিএও স্টোর সিআরবি) আইবাস সিস্টেমে হাবিব উল্লা খান হাবিবের সম্পাদিত টোকেন ও এন্ট্রি করা বিলটি অনুমোদন দেন এবং রেজিস্ট্রারে বিলের কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ না করেই নিজ ইচ্ছায় উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত জালিয়াতির আওতায় বিল পাস করেন। এভাবেই রেলওয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার মাধ্যমে এ দুর্নীতি হয় বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close