জাহিদুল ইসলাম

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠিন পরীক্ষায় সরকার

টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে টালমাটাল পরিস্থিতি। কখনো পণ্যের দাম বেড়ে যায় খুব আবার কখনো তলানিতে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতির এমন পরিস্থিতির মারাত্মক শিকার হচ্ছে। বৈশ্বিক যেকোনো বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশে যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তা পৃথিবীর আর কোথাও বাড়েনি। ফলে বৈশ্বিক সংকটের চেয়েও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার অভাবকেই তারা বেশি দুষছেন। এ অবস্থায় সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকারের জন্য দ্রব্যমূল্য; বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম জনসাধারণের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসাকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলছেন তারা।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বরাতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানায়, গত ৫ বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম ১২ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বেড়েছে মিনিকেট চাল, যা ৫ বছর আগে ছিল ৫৮ টাকা; বর্তমানে এ চালের দাম ৬০-৬৫ টাকা। আর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দেশি রসুনের দাম, যা ৫ বছর আগে ৫০ টাকায় বিক্রি হতো; বর্তমানে অন্তত ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সোমবার টিসিবির ওয়েবসাইটে এ পণ্যটির দাম ২৬০-২৮০ টাকা উল্লেখ ছিল।

তবে নির্বাচনের আগে গার্মেন্টকর্মীদের ন্যূনতম বেতন ১০ হাজার টাকা থেকে ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করেছে সরকার। এছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টসহ আরো ৫ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে তাদের বেতন ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে সমাজের উচ্চশ্রেণি ছাড়া কারো পক্ষেই বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের কাছে এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাই স্বীকার করছেন।

এক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ডলার সংকট কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো ভূমিকার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সরকার চাইলে এসবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনাই সবচেয়ে বড় কারণ। মাঝে মাঝে পেঁয়াজ, তেলের মতো কিছু কিছু পণ্যের দাম হঠাৎ উঠে যায়। এটাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সে সময় প্রয়োজন হয় ব্যক্তিগত পর্যায়ে পণ্য আমদানির। কিন্তু ডলার সংকটে আমাদের আমদানি বন্ধ থাকায় তখন আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

এছাড়া খুচরা পর্যায়ের দাম নির্ধারণ করে দিয়েও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার পণ্যের যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, সে দামে কোথাও পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে উৎপাদন ও খুচরা পর্যায়ের মাঝে যে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি আছে, তারা কীভাবে বাজার ম্যানিপুলেট সেটা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া দাম নির্ধারণ করে হয়তো মাঝে মাঝে খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা যাবে, কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে না। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রভাবশালী নয়, তারা কোনো কিছু ঠিক করে দিতে পারে না। যারা এটা করে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারা এসব করে সেটা যে সরকার জানে না, সেটা মানতে পারি না।

তিনি বলেন, কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া সরকারের কাজ নয়, বরং সরকারকে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। ছোট-বড় ব্যবসায়ী সবাই যেন এখানে প্রতিযোগিতা করতে পারেন, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া কোন বাজারে কারা কোন পণ্যের বড় ব্যবসায়ী, কারা ম্যানিপুলেট করতে পারেন, তাদের পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ মনিটরিং করা। এখানে আইনের প্রয়োগটা বড় বিষয়। যদি বড় প্রভাবশালীকে না ধরে তাকে কারসাজির সুযোগ দেওয়া হয় আর ছোটদের জেল-জরিমানা করা হয়, তাহলে তো সমতল মাঠ হবে না।

অন্যদিকে ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ডলার সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে ডলারের জোগান বাড়ানো। এক্ষেত্রে ডলার রেট বাফেদা বা এবিবির ওপর ছেড়ে না দিয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া দরকার। কারণ সরকার যে রেট নির্ধারণ করে দেয়, তার চেয়ে ১০-১৫ টাকা বেশি পাওয়া যায় বাইরে। তাহলে কে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করবে? আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলারের চাহিদা কমানো সম্ভব নয়। এতে আমদানি কমে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সংকট হয়ে পণ্যের দাম বাড়বে। তাই ডলার রেট ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দিলে তারা তাদের বৈদেশিক এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে কথা বলে ডলার রেট নির্ধারণ করতে পারে। এতে অন্তত ডলারের জোগান বাড়বে, সংকট তৈরি হবে না।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের মুদ্রানীতি, আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা, রাজস্বনীতি, বাণিজ্যনীতি এসব হলো পলিসি ম্যাটারস। এসবের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। মার্কেট ইন্টারভেনশন করতে পারে, সাবসিডি দিতে পারে, শুল্ক কমাতে পারে, নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে মার্কেট সিন্ডিকেট কমে আসবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার চাইলে সবকিছু পারে।

একই অভিমত ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সরকারের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা মূলত দাম বাড়ানোর পেছনে কাজ করেছে তারাই নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় আছে। শুধু ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ওপর দাম নির্ধারণ হয় না। চালের দাম হঠাৎ করে বাড়ল কোনো কারণ ছাড়াই। যখন মন্ত্রী অনুরোধ করলেন, তখন ব্যবসায়ীরা ২০ টাকা যে বৃদ্ধি করেছে সেখান থেকে ২ টাকা কমিয়েছে।

এফবিসিসিআইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিন হেলালী বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সাপ্লাই ও ডিমান্ড দেখতে হবে। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের মজুদ আছে কত, পাইপলাইনে কত আর পোর্টে কত আছে, সেটা দেখতে হবে। আর অভ্যন্তরীণ পণ্যের ক্ষেত্রে কোথায় কত উৎপাদন হয়েছে এবং কোন মাসে কত ডিমান্ড আছে, সেটা যখন ডিজিটালাইজড হবে, তখন ঠিক হবে। আমাদের বর্তমান মন্ত্রী সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি, তিনি যদি ডাটাবেজ কাজটি সাকসেসফুলি করতে পারেন, তাহলে কোনো সমস্যা থাকবে না।

এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গত রবিবার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সভাপতিত্ব করেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বৈঠকে ৪টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে বিশ্ববাজারে দাম বেশি এমন পণ্যের শুল্ক কমানোর সুপারিশ, ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় ডলার সহায়তা, অবৈধ মজুদদারী কঠোরভাবে দমন এবং ডলার সংকট হলে বিকল্প মুদ্রায় পণ্য আমদানি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close