কাইয়ুম আহমেদ

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪

পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারবিরোধী অবস্থান বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিল দেশটি। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছিল। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলো থেকেও ছিল নানা চাপ। কিন্তু কোনো কিছুতেই নতি স্বীকার করেননি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সংবিধানসম্মতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করেছেন তিনি। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় তাকে এরই মধ্যে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এরমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।

অভিনন্দন জানানো দেশগুলোর মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান অন্যতম। কারণ নির্বাচনের বছর দেড়েক আগেও জাপানের তখনকার রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করেছিলেন। আর জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন শক্তিশালী সংগঠনের অভিনন্দনবার্তায় আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী নতুন সরকার। ফলে সরকারের এক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বলয় শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে। এমন বার্তা পাওয়া গেছে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের সৌজন্য সাক্ষাৎ বা বৈঠক থেকেও। যুক্তরাষ্ট্রের আচরণেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে দেশটির ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর ঘোষণা ও সর্বশেষ শ্রমনীতি সরকারকে চাপে ফেলেছিল। তবে গত রবিবার সচিবালয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের লেবার অ্যাটাশে লিনা খান ও ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) ম্যাথু বেহে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে।

বৈঠকে শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা গত বছর থেকে হচ্ছে। সময়ে সময়ে যে অগ্রগতি হয়েছে তা আরো অগ্রগতি সম্ভব কি না, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমনীতি নিয়ে যে বিরোধ-সেটাও কাটিয়ে উঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস অভিনন্দনবার্তায় বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমের (বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের কর্মী) মাধ্যমে আপনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে জাতিসংঘ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে যে রূপরেখা দিয়েছেন, তাতে আমি অনুপ্রাণিত। এসব মূল্যবোধে গুরুত্বপূর্ণ কাজ অব্যাহত রাখতে কমনওয়েলথ আপনাকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।

শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøøাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বের চেতনায় বিকশিত হয়ে আসছে। আশা করি, সরকারপ্রধান হিসেবে আপনার কার্যক্রম আমাদের দেশের জনগণের সুবিধার জন্য গঠনমূলক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করতে আরো অবদান রাখবে।

অভিনন্দন জানিয়েছে, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) ও কনফারেন্স অন ইন্টারঅ্যাকশন অ্যান্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস ইন এশিয়া (সিআইসিএ)।

কানাডার পাঁচ সংসদ সদস্যও অভিনন্দন জানিয়েছেন শেখ হাসিনাকে। গত ৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে কানাডার এমপিরা বলেছেন, ‘এটি সত্যিই আপনার এবং আপনার সহকর্মীদের জন্য একটি কৃতিত্ব।’

অভিনন্দন জানিয়েছেন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান অধ্যাপক ক্লাউস সোয়াব। একই সঙ্গে মধ্য জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে আসন্ন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ৫৪তম বার্ষিক সভায় যোগ দিতে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

৯ জানুয়ারি শুভেচ্ছাবার্তায় ক্লাউস সোয়াব লেখেছেন, নির্বাচনে আপনার দল ঐতিহাসিক জয় লাভ করায় আমার অভিনন্দন নিন। নতুন মেয়াদে আপনার এবং আপনার সহকর্মীদের সফলতা কামনা করি। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে আপনার সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এক সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম মুখিয়ে আছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত করবে আশা প্রকাশ করে ক্লাউস সোয়াব বলেন, আপনার নেতৃত্ব নেওয়া সাহসী সংস্কারগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে উন্নীত করতে সাহায্য করেছে। আমি আত্মবিশ্বাসী, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে।

একইদিন গণভবনে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রদূতরা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলও। ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যান স্টিভেন কোবোস বলেন, বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল এবং ইউএস প্রাইভেট সেক্টর গঠনমূলক পরামর্শ এবং ব্যস্ততার মাধ্যমে চিন্তাশীল অংশীদার হিসেবে উন্নয়নের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার এবং আপনার সরকার এবং জনগণের সঙ্গে অবিচল সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন- বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ; এসব কারণে রাজনৈতিক মেরুকরণের নতুন ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি ঠিক রেখেই চলে। প্রথমে চেয়েছিল যাতে নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হয় এবং বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশ নেয়। সরকারকে চাপ দিয়ে হয়ত দলটিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে বাধ্য করত। কিন্তু কাউকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করা তো সরকারের কাজ না। আবার বিএনপিতে শীর্ষ দুজনই (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) সাজাপ্রাপ্ত। এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় তারা ভোটের মাঠে না নামার জন্য কৌশলে নেতাদের নির্দেশ দেন। ফলে দলটি নির্বাচন থেকে সরে আসে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি পরিবর্তন করল মাত্র। কারণ, তারা দেখল পশ্চিমা বিশ্ব নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে, তখন তারাও সরকারকে অভিনন্দন জানাল। একই পথে হাঁটল জার্মান, ফ্রান্সও।

একই বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মোনায়েম সরকার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের দোষর এবং সিপিডিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নির্বাচন বানচালে এমন অপপ্রচার চালায় যাতে বিদেশিরা বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়, কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। তবে পরে বাস্তবতা বুঝে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদেশগুলো শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা, অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়। তাছাড়া তারা দেখেছে, বাংলাদেশের সাড়ে ১৭ কোটি জনগণের মধ্যে ৪২ ভাগই ভোট দিয়েছে। তাদের দেশগুলোয়ও নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পড়ে না। ফলে তারা নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং কূটনীতিকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয়লাভ করে ১১ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close