নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৪

এলএনজির সরবরাহ বাড়াতে পাইপলাইন নির্মাণে জোর

স্থানীয়ভাবে গ্যাসের উত্তোলন কমতে থাকায় ভবিষ্যতে আরো বেশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত এ আমদানি চালান সরবরাহের জন্য ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার।

প্রস্তাবিত ২৯৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ পাইপলাইনটি ২০২৯ সাল নাগাদ নির্মাণ করা হবে। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) জানিয়েছে, এটি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে দৈনিক অতিরিক্ত ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করবে।

জিটিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন লাভের পর বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হবে।

পিডিপিপি অনুযায়ী, এ বছরই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করে ২০২৯ সালের মধ্যে তা শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ২০৩৩ সালের মধ্যে দেশের বর্তমান গ্যাস রিজার্ভ সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তখন গ্যাসের দৈনিক চাহিদা হবে ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে করা হচ্ছে এই পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা।

জিটিসিএলের তথ্য মতে, আমদানি করা এলএনজি এবং বাংলাদেশের দৈনিক গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যার বিপরীতে দৈনিক চাহিদা হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্থানীয়ভাবে দৈনিক উত্তোলন (উৎপাদন) করা হচ্ছে ২,১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া, মহেশখালী-আনোয়ারা, আনোয়ারা-ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ পাইপলাইনগুলোর মাধ্যমে দৈনিক আরো ৮৫০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, প্রস্তাবিত স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল থেকে আমদানি করা এলএনজি সরাসরি ঢাকায় পৌঁছে দেবে প্রস্তাবিত নতুন পাইপলাইন। ২০৩০ সাল পর্যন্ত কতটুকু আমদানি করা হবে তার একটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন বা এক মাসের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করা হবে। তখন আমদানি পরিকল্পনা ও দর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আরো বলেন, নতুন পাইপলাইনটি মূলত চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে অতিরিক্ত দূরত্বে গ্যাস সরবরাহের জন্য নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান পাইপলাইনগুলো বাখরাবাদে এলএনজি সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়।

জ্বালানি সচিব মো. নুরুল আলম বলেন, ভবিষ্যতে মাতারবাড়ীতে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার এলএনজি টার্মিনাল থাকবে আরো টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের চাহিদা ও আমদানির কথা মাথায় রেখে নতুন পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

জিটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ মাহমুদ বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আগামী এক বছরের মধ্যে এটি শেষ হলে প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় সম্পর্কে জানা যাবে।

দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে একটি সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। এই সংকট মোকাবিলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ।

মহেশখালীতে প্রত্যেকটি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণ করেছে এক্সিলারেট এনার্জি (২০১৮ সালে) ও সামিট (২০১৯ সালে)। এ দুটি স্থাপনা থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৮৫০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হতো। তবে এক্সিলারেট এনার্জির ইউনিটে বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে, এজন্য মহেশখালী থেকে দৈনিক মাত্র ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।

জিটিসিএলের তথ্য মতে, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। এছাড়া, সামিট মহেশখালীতে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার তৃতীয় এফএসআরইউ স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এক্সেলরেট এনার্জিও তাদের ইউনিটের বিদ্যমান সক্ষমতা দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে। ফলে ২০২৬ সাল নাগাদ মহেশখালী থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।

মাতারবাড়ীতে একটি ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনাসহ ২০৩১-৩২ সালের মধ্যে এই সরবরাহ দৈনিক ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরেও সম্ভাব্য গ্যাসের মজুদ আবিষ্কারের প্রত্যাশা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাড়তি এই গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ পাইপলাইন নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানির কোনো বিকল্প নেই। আর তা বিতরণের জন্য পাইপলাইনও দরকার। তবে মাতারবাড়ীতে ভূমিভিত্তিক টার্মিনাল নির্মাণের আগেই পাইপলাইন নির্মাণ করা হলে অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের যথেষ্ট গ্যাস নেই জানার পরও সরকার রংপুর, রাজশাহী ও খুলনায় গ্যাস সরবরাহ করতে পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। এখন সরকার গ্যাস সরবরাহ করে রাজস্ব আদায় করতে না পারায় পাইপলাইন বিছানোর ব্যয় বাবদ অর্থ আয় করতে পারছে না।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, আগে ল্যান্ড বেইজ স্টেশন নির্মাণ করতে হবে। কারণ ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে পাইপলাইন নির্মাণের পরে যদি দেখা যায় মাতারবাড়ীতে আর ল্যান্ড-বেইজড স্টেশন আর নির্মাণ করা হচ্ছে না তখন পাইপলাইন নির্মাণ করাটাই হবে অপচয়।

স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান : গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খননের কাজ শুরু করেছে। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আরো ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো আগামী দুই বছরের মধ্যে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০২৭ সাল নাগাদ আমাদের গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছাবে। এই সময়ের মধ্যেই আমরা গ্যাস উৎপাদনে স্ব-নির্ভরতা অর্জন করতে চাই। বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক গ্যাস চাহিদা হলো ১ লাখ কোটি ঘনফুট।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, দেশের মোট গ্যাস মজুদের পরিমাণ ৪০ লাখ ২৩ হাজার কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে মোট উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ২৮ লাখ ৬২ হাজার কোটি ঘনফুট। এ হিসেবে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত উত্তোলনযোগ্য অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৬৮ হাজার কোটি ঘনফুট।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close