নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

গ্যাস কম, জ্বলে না চুলা ধুঁকছে কারখানা

‘সকাল ৭টার পর চুলায় গ্যাস থাকে না। রান্না তো দূরের কথা, এখন যে গ্যাস পাওয়া যায়, তাতে পানিও গরম হয় না। অনেক সময় বাধ্য হয়ে ইলেকট্রিক চুলায় রান্না করতে হয়’- বলছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা খাদিজা আকতার। এ সমস্যা শুধু মোহাম্মদপুরেই নয়; ডেমরার আমুলিয়া, হাজীনগর, কোলাটিয়া, মিরপুরের পূর্ব শেওড়াপাড়া, শ্যামলী, পল্লবী, ভাসানটেক, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরার বনশ্রী, গেণ্ডারিয়া, নবাবগঞ্জ, নারিন্দাসহ পুরান ঢাকার অনেক এলাকার। অবার একই সংকটের কারণে শিল্প-কারখানার উৎপাদনও কমেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সহসা এ সংকট থেকে রেহাই মিলছে না। তবে মার্চের পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে পারে। বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে আমদানি করা এলএনজি থেকে।

বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারের অতিমাত্রায় আমদানিপ্রীতির কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দীঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে চরম অবহেলার কারণে দেশি গ্যাসের উৎপাদন কমছে। উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে বিপুল পরিমাণ যে ডলারের প্রয়োজন, সেখানেও ঘাটতি রয়েছে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় এমনিতেই গ্যাস সংকট। তার ওপর আবার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য বন্ধ রয়েছে। চাইলেও এলএনজি আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, গ্যাসের অভাবে কারখানার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শিপমেন্ট শিডিউল ফেল করার কারণে ক্রেতারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কূপ খনন ও সংস্কার করে কাঙ্ক্ষিত গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, সেটা এখনই বলা মুশকিল। তা ছাড়া নতুন করে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে যে বিপুল পরিমাণ ডলার দরকার, সেটি জোগাড় করা না গেলে আমদানি ব্যাহত হবে। এ সময়ে দেশের পুরোনো কূপ থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে চলমান সংকট কতটা দূর হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও দিনে চুলা জ্বলছে না। কখন গ্যাস আসবে- সেই অপেক্ষায় থাকেন গৃহিণীরা। অনেকেই লাকড়ির চুলায় রান্না করেন। কেউ হোটেল থেকে খাবার কিনে আনেন। পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকার জাহাঙ্গীর হোসেন বাবু জানান, গ্যাস সংকটে রাত ৩টা পর্যন্ত তাকে রান্না করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে বিল দিচ্ছি, কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছি না। যদিও আমাদের এলাকায় বেশির ভাগ জায়গায় গ্যাসের সংযোগ আছে, তবে বাসিন্দারা এলপিজি ব্যবহার করছেন। কিন্তু এলপিজির ব্যয় বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই আমাকে রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় গ্যাসের জন্য।

উত্তরাখানের মাদারবাড়ী এলাকার দোতলা ভবনে ভাড়াটিয়াদের নিয়ে থাকেন মোহাম্মদ হাসান। তার বাড়িতে সারা দিন গ্যাস না থাকায় বাধ্য হয়ে ছাদে মাটির চুলায় জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্না করা হয়ে। ভাসানটেক বিআরপি এলাকার প্রায় ২ হাজার ৫০ পরিবারের কেউ জ্বালানি কাঠ, আবার যাদের আয় ভালো, তারা এলপিজি ব্যবহার শুরু করেছেন। কারণ তাদের এলাকায় গ্যাস থাকে রাত দেড়টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। ওই এলাকায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় দুই বেড রুমে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন হাসনা বানু। তিনি বলেন, রান্না করার জন্য আমাদের মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। অথচ আমরা দিনের সব সময় ব্যবহারের জন্যই গ্যাসের বিল পরিশোধ করছি।

আজিমপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি আসতেন। এখন তাকে বাইরে খেতে হচ্ছে। কারণ গ্যাসের অভাবে তার স্ত্রী দিনের বেলা রান্না করতে পারছেন না। বিরক্ত নিয়ে রানা বলেন, এভাবে বেশি দিন বাইরে খাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই। তবে এই দুর্ভোগ শিগগিরই কমার সম্ভাবনা নেই বলে পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এলএনজি আমদানি করে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে, তা আবার গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল গত ১ নভেম্বর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, শিগগিরই এটি চালু হবে। এটি চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। দুটো টার্মিনাল মিলে গ্যাস সরবরাহ করে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর যেটি চলছে, সেটি বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে।

পেট্রোবাংলার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরবরাহ প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো বাড়বে, যা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত হবে না। সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রসহ স্থানীয় ক্ষেত্রগুলোয়ও গ্যাসের উৎপাদনও কমছে।

স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। তিনি বলেন, তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে আমরা এরই মধ্যে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করছি। তাৎক্ষণিক গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে বর্তমানে ডলার মজুদের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম।

এদিকে, চলমান সংকট নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমানে এ সংকট সাময়িক। গভীর সমুদ্রে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সংস্কারকাজে হাত দেওয়ার কারণে এখন গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কম। আগামী মার্চে রোজা শুরুর সময়ে গ্যাস এবং বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছি। মার্চের আগেই এলএনজি টার্মিনাল দুটি পুরোপুরি সচল হয়ে যাবে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। আশা করছি দুই বছরের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ করা যাবে। এলএনজি আমদানিও বাড়বে। সবমিলিয়ে ২০২৬ এর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার টার্গেট রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close