গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪

পছন্দের ফ্ল্যাট পেতে দৌড়ঝাঁপ এমপিদের

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হয়েই ন্যাম ভবনে পছন্দের বাসা পেতে দৌড়ঝাঁপ ও তদবির শুরু করেছেন অনেকে। এরই মধ্যে অন্তত ১১১ জন এমপির আবেদন জমা পড়েছে চিফ হুইপের দপ্তরে। আবেদনকারীদের মধ্যে নতুন-পুরোনো এমপিদের পাশাপাশি সাবেক একজন মন্ত্রীও রয়েছেন। তারা আবেদন করেই বসে থাকেননি, কেউ কেউ ধরনা দিচ্ছেন আরো বড় ভিআইপির দপ্তরে। এমন অসংখ্য ভিআইপির সুপারিশ পেয়ে হতবাক সরকার দলীয় চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদে বরাদ্দ পাওয়া সব এমপিকে বাসা ছাড়তে চিঠি দিয়েছে সংসদ সচিবালয়ের সদস্য ভবন শাখা। আগামী ২৯ জানুয়ারি একাদশ সংসদের মেয়াদপূর্ণ হবে; চিঠিতে তার আগেই বাসা ছাড়তে এমপিদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। তারা বাসা ছাড়লে ফ্ল্যাটগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্বাদশ সংসদের এমপিদের বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

৭ জানুয়ারির ভোটের পর গত ১০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের এমপিরা শপথ নেন। আর মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা শপথ নেন ১১ জানুয়ারি। সংসদ অধিবেশন শুরু হবে আগামী ৩০ জানুয়ারি। এরই মধ্যে রাজধানীর মানিকমিয়া এভিনিউয়ে অবস্থিত সংসদ সদস্য (ন্যাম) ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য শুরু হয়ে গেছে দৌড়ঝাঁপ।

সংসদ সচিবালয়ের সদস্য ভবন (হোস্টেল) শাখা সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ১১১ জন এমপি ন্যাম ভবনের বাসা চেয়ে আবেদন করেছেন।

নাম প্রকাশে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, যারা ফাইভ স্টার হোটেল সোনারগাঁও, শেরাটনে সকাল-দুপুর-রাতের খাবার খান, এমনকি রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সুরম্য অট্টালিকায় পুরো পরিবার নিয়ে বসবাস করেন, তারাও হুইপের দপ্তরে গিয়ে ন্যাম ভবনের বাসা পেতে সরাসরি করছেন তদবির। এমনো বলছেন, ঢাকায় তাদের অবস্থান করার মতো বর্তমানে কোনো ঠিকানা নেই।

জানা গেছে, ঢাকায় অভিজাত এলাকায় ঠিকানা সত্ত্বেও ন্যাম ভবনের বাসার জন্য তদবিরকারীদের মধ্যে খুলনা অঞ্চলের একজন এমপি রয়েছেন, যিনি সাবেক ফুটবলার এবং দেশের একজন বড় ব্যবসায়ী। তার ঢাকা শহরে বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই রয়েছে। তারপরও চাচ্ছেন ন্যাম ভবনের বাসা।

তদবিরকারীদের মধ্যে আরেকজন রয়েছেন সাবেক প্রভাবশালী এক মন্ত্রী। তিনি তদবির চালাচ্ছেন, তার পছন্দের ৪ নম্বর ন্যাম ভবনের ১০৩ নম্বর বাসার জন্য। এ বাসায় তার বেয়াই একাদশ জাতীয় সংসদের কুড়িগ্রামের এমপি এম এ মতিন (নমিনেশন পাননি এবার) থাকতেন।

একইভাবে ব্রাক্ষণবাড়িয়া-১ নাসিরনগরের এমপি, পিরোজপুর-৩ আসনের এমপি, সাতক্ষীরা-৪ আসন, সাতক্ষীরা-২ (সদর), যশোর-৬ আসনেরসহ শতাধিক এমপি ন্যাম ভবনে পছন্দের বাসা পেতে তদবির দৌড়ঝাঁপ করছেন চিফ হুইপের দপ্তরে।

সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের যারা এমপি ছিলেন, দ্বাদশ সংসদেও নির্বাচিত হয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান বাসাটি বরাদ্দের আবেদন করছেন। আবার অনেকেই বর্তমান বাসা ছেড়ে আরেকটু ভালো পছন্দানুযায়ী বাসা পেতে তদবির করছেন। এছাড়া নতুন আসনে যারা এমপি হয়ে এসেছেন তাদের অনেকে চাচ্ছেন তার আসনের যিনি এমপি ছিলেন, সেই বাসাটি তার নামে বরাদ্দ দিতে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এমপি বরাদ্দের জন্য তদবির করছেন।

সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব এমপি ও ভিআইপিদের বেশির ভাগই নিজেরা কখনই ন্যাম ভবনে থাকেন না, থাকে তাদের পিএ, ড্রাইভার ও স্টাফরা। তাদেরই অনুরোধে এমপিরা বাসা বরাদ্দের তদবির নিয়ে আসছেন।

এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল একাদশ জাতীয় সংসদে। ওই সংসদে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের ছেলে নিজাম উদ্দিন জলিল জন ন্যাম ভবনের বাসা বরাদ্দ চেয়ে একজন ভিআইপির তোপের মুখে পড়েছিলেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তুমি তো সকালের নাশতা কর সোনারগাঁয়ে, তবে এই বাসায় থাকবা না তা কেন বরাদ্দ চাইছো। জবাবে তিনি বলেছিলেন, স্টাফদের চাপে বাধ্য হয়ে এসেছি।

এদিকে এত আগেভাগেই ন্যাম ভবনে বরাদ্দ পেতে এমপিদের বহুমাত্রিক তদবিরে বিস্মিত ও হতবাক চিফ হুইপ নিজেও।

জানতে চাইলে চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাসা বরাদ্দের আবেদন করছেন দ্বাদশ সংসদের এমপিরা। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন। সবাই চাচ্ছেন, তার পছন্দের বাসাটি বরাদ্দ পেতে। আবার যার বাসা প্রয়োজন নেই, এমন অনেক এমপি নিজেও এসে ন্যাম ভবনের বাসার জন্য অনুরোধ করছেন।

চিফ হুইপ জানান, এরই মধ্যে একাদশ সংসদের এমপিদের বরাদ্দ বাসা ছাড়তে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নতুনদের বাসা বরাদ্দের আগে কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। আগে সংস্কার হবে তারপর নতুন বরাদ্দের প্রক্রিয়া। সেক্ষেত্রে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার পর গঠন হবে হাউস কমিটি। এ কমিটি সভা আহ্বান করে এমপিদের জ্যেষ্ঠতা, প্রাপ্যতা বিবেচনা করে বাসা বরাদ্দ দেবে।

পুরোনো এমপিদের বাসা ছাড়তে বলার চিঠির ব্যাপারে সদস্য ভবনের সিনিয়র সহকারী সচিব আবদুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদের এমপিদের বরাদ্দ বাসা ছাড়তে গত ৭ জানুয়ারি ভোটের আগেই চিঠি দিয়েছি। গত পাঁচ বছর এমপিরা এসব বাসা ব্যবহার করেছেন। নতুনভাবে বরাদ্দের আগে বাসাগুলোর সংস্কার কাজ সম্পন্নের জন্য বাসা ফাঁকা করা জরুরি। তাই চিঠি দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সংসদে নির্বাচিত ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত আসনের ৫০ নারী মিলিয়ে এমপি ৩৫০ জন। এর মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপরা ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের নিজস্ব ভবন বাদে ২৬৫টির মধ্যে বাসা নির্মিত হয়েছে ন্যাম ভবনে। অনেক এমপির ঢাকায় নিজের বা পৈতৃক সম্পত্তি থাকায় তাদের বাদ দিয়ে অন্য এমপিদের মধ্যে জরুরি বিবেচনায় বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ন্যাম ভবনে দুই ক্যাটাগরির বাসা রয়েছে। একটির আয়তন ১৫৫০ স্কয়ার ফুট এবং দ্বিতীয়টির ১২৫০ স্কয়ার ফুট। এর মধ্যে বড় বাসার ভাড়া ৬০০ টাকা ও ছোট বাসার জন্য ৪০০ টাকা। দ্বিতীয়বার যারা এমপি হয়ে আসেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৬০০ টাকা ভাড়া মূল্যের বাসা এবং নতুন এমপিদের দেওয়া হয় ৪০০ টাকা মূল্যের বাসা। আবার চিফ হুইপ চাইলে তার এখতিয়ার অনুযায়ী নতুনদেরও বড় বাসা বরাদ্দ দিতে পারেন। কারণ সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিতে বাসা বরাদ্দের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close